হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হযরত আলী (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, একদিন আমি হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে বসা ছিলাম, এ সময় হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী এসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)! আমার মা-বাপ আপনার জন্য কোরবান হোক। আমাকে বলুন, সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা কোন বস্তু সৃষ্টি করেছেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম এক হাজার বছর ধরে আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। আর সেই এক দিন তোমাদের এই দুনিয়ার হিসাবে এক হাজার বছরের সমান। আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট আমার নূর আল্লাহর মহত্ত্ব মর্যাদা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত এবং আল্লাহর তসবীহ পাঠ, তাওয়াফ ও সজদায় মশগুল থাকত।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলে, সৃষ্টি শূন্য অবস্থায় নূরে মুহাম্মদী (সঃ) বার হাজার বছর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার এবাদতে রত থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নূরে মুহাম্মদী (সঃ)-কে চার ভাগে বন্টন করে এক ভাগ দ্বারা আরশ, এক ভাগ দ্বারা কলম, এক ভাগ দ্বারা জান্নাত এবং একভাগ দ্বারা আলমে আরওয়াহ ও সমগ্র মাখলুক সৃষ্টি করেন। উল্লেখিত চার প্রকার থেকে তিন প্রকার বের করে আল্লাহ তাআলা জ্ঞান-বিবেক, লজ্জা ও প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা এবং এক প্রকার থেকে সম্মানিত সৃষ্টি আমাকে সৃষ্টি করেন।
এক হাদীসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন- আমি আল্লাহর সৃষ্ট নূর থেকে সৃষ্টি এবং আমার নূর থেকে সমগ্র জগত সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কলমকে হুকুম করেন আরশের উপর কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লেখতে। কলম আল্লাহর হুকুম পেয়ে চারশ’ বছর পর্যন্ত কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লেখতে থাকে। আরেক বর্ণনায় রয়েছে, কলম লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পর্যন্ত লিখে নিবেদন করল- ইয়া রাব্বাল আলামীন! আপনি তো উপমা ও তুলনাবিহীন, আপনার নামের সাথে এই সম্মানিত নাম কার শোভা পাচ্ছে? আল্লাহর তরফ থেকে আওয়াজ এল, এই নাম আমার সম্মানিত হাবীবের। তুমি লেখ- মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এই হুকুমে আল্লাহ তাআলার ভীতিকর সম্বোধনের প্রভাবে কলমের মুখ ফাঁক হয়ে যায় এবং কলম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লেখে। তখন থেকেই কলমের মুখে ফাঁক রাখার রীতি চালু হয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা আরশের উপর আঠার হাজার বুরুজ সৃষ্টি করেন এবং প্রত্যেক বুরুজ আঠার হাজার খুঁটির উপর স্থাপন করা হয়। প্রত্যেক খুঁটির উপর এক হাজার ঝাড় তৈরী করা হয়। এক ঝাড় থেকে আরেক ঝাড়ের দূরত্ব সাতশ’ বছরের পথ এবং প্রত্যেক ঝাড়ে আঠার হাজার বাতি স্থাপন করা হয়। প্রতিটি বাতি এত বড় যে, সাত আসমান-যমীন এবং তন্মধ্যস্থ সব কিছু তাতে এমনভাবে সামাল হয়ে যাবে, যেন বৃহৎ বিস্তৃত মাঠের মধ্যখানে একটি আঙ্গুল রেখে দেওয়া হয়েছে। এরপর বৈচিত্র্যময় আকৃতির চার জন ফেরেশতা সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্ট চার ফেরেশতার উপর আরশ উঠানোর আদেশ হয়। আদেশ প্রাপ্ত হয়ে তারা সর্বশক্তি দিয়ে আরশ উঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করলেন, হে ফেরেশতারা! আমি তোমাদেরকে সপ্ত আসমান যমীন এবং তন্মধ্যস্থ সবকিছুর শক্তি দান করেছি। সুতরাং তোমরা আরশ উঠাও। এই নির্দেশ পেয়ে তারা ‘পুনঃ জোর প্রচেষ্টা চালিয়েও অক্ষম-অপারগ থেকে যায়। তখন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে এরশাদ হল, এই তাসবীহ পড়ে উঠাও- “সোবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকূতি সোবহানা যিল ইযযাতি ওয়াল আযমতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কামালি ওয়াল জালালি ওয়াল জামালি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জাব্বারূত, সোবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাযী লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু সুব্বুহুন কুদ্দসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওয়াররূহ”।
Related: মুসা (আঃ) কর্তৃক খিযির (আঃ) হইতে এলেম আহরণ সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
আরশ উত্তোলনে নিয়োজিত ফেরেশতাগণ এই তাসবীহ পাঠ করলে আল্লাহর কুদরতে উঠাতে সক্ষম হন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে আরেক রেওয়ায়াতে আছে আরশ উত্তোলনকারী চার ফেরেশতা নিম্নোক্ত তাসবীহ পাঠ করেন, তখন আরশ উঠাতে সক্ষম হন- “সোবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম”।
আরেক রেওয়ায়াতে আছে, এই তাসবীহ পাঠ করা হলে আল্লহ তাআল জান্নাত এবং ফেরেশতাকূলকে সৃষ্টি করেন। যাতে ফেরেশতাগণ আরশের চতুর্দিকে ঘুরে তাসবীহ পাঠ ও তাওয়াফ করে মোমেন বান্দাদের জন্য ক্ষমা চাইতে পারেন।
এরপর আরশের নীচে মারওয়ারীদ পাথরের একটি দানা সৃষ্টি হয়, তা হতে আল্লাহ তাআলা লওহে মাহফুজ তৈরী করেন। লওহে মাহফুজ দৈর্ঘ্যে সাতশ’ এবং প্রস্থে তিনশ’ বছরের রাস্তা, চতুর্দিকে লাল ইয়াকুত পাথর জড়ানো। লওহে মাহফুজ তৈরী শেষে কলমের প্রতি আল্লাহর হুকুম হয় লেখ—“আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টিকুল সম্পর্কে তাঁর এলেম এবং কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টিকুলে অণু পরিমাণ যা অস্তিত্ব লাভ করবে তার এলেম লেখ। তখন লওহে মাহফুজে লিখিত হয়- কোরআনের আয়াতের বাংলা অর্থ “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। আমিই সকলের মা’বুদ পরওয়ারদেগার। আমি ছাড়া আর কোন মা’বুদ পরওয়ারদেগার নাই। যে আমার নির্ধারিত তাকদীরের উপর সন্তুষ্ট এবং আমার প্রদত্ত বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে আর আমার প্রদত্ত নে’মতের উপর শোকর করে; আমি অবশ্যই তাকে ছিদ্দিকীনের শামিল করব। আর যে আমার নির্ধারিত তাকদীরের উপর অসন্তুষ্ট এবং আমার প্রদত্ত বিপদাপদে ধৈর্য্ধারণ করে না, আমার প্রদত্ত নে’মতের শোকর করে না, তবে সে যেন আমি ব্যতীত অন্য কোন মা’বুদ পরওয়ারদেগার খুজে নেয় এবং আমার আসমানের নীচ হইতে বের হয়ে যায়”।
উল্লেখিত নির্দেশ বাণী লেখার পর নিজে থেকেই লওহে মাহফুজ নড়েচড়ে বলে উঠে- আমার মত কোন সৃষ্টির অস্তিত্ত্ব নাই কেননা, আমার গাত্রে আল্লাহর এলেম লিখিত হয়েছে।তখন আল্লাহর তরফ থেকে আওয়াজ আসে- যার অর্থ হচ্ছে- “আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা রাখেন আর যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন, আর তাঁর নিকটই রয়েছে আসল কিতাব।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা যা কিছু নির্ধারণ করেছেন, কক্ষনো তাতে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন হবে না। তবে হায়াত, মউত, রিযিক ও সৌভাগ্যে দুর্ভাগ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হতে পারে। অতঃপর আরশের নিম্নস্থ মারওয়ারীদের প্রতি নির্দেশ হল- প্রসারিত হও, তখন সেটি প্রসারিত হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, (ওয়াসিআ কুরসিয়্যুহুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা) অর্থাৎ তাঁর কুরসী প্রসারিত হয়েছে আসমান যমিনব্যাপী। এরপর কুরসীর নীচে ইয়াকুতের একটি দানা সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ বলেন, সেটি ইয়াকুত নয়; বরং মারওয়ারীদের দানা। সেটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ পাঁচ’শ বছরের রাস্তার সমপরিমাণ। সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা যখন সেটির প্রতি তাকান, তখন সেটি আল্লাহর ভয়ে আপনা আপনিই পানি হয়ে যায়।
Related: দাজ্জাল সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা চতুর্মুখী বাতাস সৃষ্টি করে নির্দেশ দিলেন- তোমরা পানির চার কোণায় তরঙ্গ সৃষ্টি করে ফেনা বের কর। নির্দেশপ্রাপ্ত বাতাস তাই করল। এরপর আল্লাহর কুদরতে ধোঁয়াযুক্ত আগুন সৃষ্টি হয়ে সে পানির উপর যায় এবং পানি হতে ধোঁয়া নির্গত হয়ে পানি ও কুরসীর মধ্যখানে বাতাসে ঝুলতে থাকে। পানি ও কুরসীর মধ্যখানে ঝুলন্ত ধোঁয়াকে আল্লাহ তাআলা সাত ভাগ করে পানি, তামা, লোহা, রূপ্য, স্বর্ণ, মারওয়ারীদ এবং লাল ইয়াকুত সৃষ্টি করেন। অতঃপর সে পানির এক ভাগ দ্বারা প্রথম আসমান, দ্বিতীয় আসমান তামার, তৃতীয় আসমান লোহার, চতুর্থ আসমান রৌপ্যের, পঞ্চম আসমান স্বর্ণের, ষষ্ঠ আসমান মারওয়ারীদের আর সপ্তম আসমান লাল ইয়াকুতের তৈরী করেন এবং প্রতি আসমানের মধ্যখানে পাঁচ’শ বছরের দূরত্ব সৃষ্টি করেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নিজের কুদরতে কুরসীর নীচে সৃষ্ট ইয়কুত বা মারওয়ারীদ হতে তৈরী পানিতে সৃষ্ট ফেনা থেকে লাল মাটির এক স্তূপ সৃষ্টি করেন, যেখানে বর্তমানে কাবাঘর বিদ্যমান। জিবরাঈল, মীকাঈল, ইসরাফীল ও আযরাঈল (আঃ) ফেরেশতাকে সে লাল মাটি চার কোণে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল- তারা সেই নির্দেশ পালন করেন এবং জমিন সেই লাল মাটির স্তূপ থেকেই সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-(খালাকাল আরদোআ ফী ইয়াওমাঈনি) অর্থাৎ আল্লাহ তাআল দুই দিনে জমিন সৃষ্টি করেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআল প্রতি আসমানে এক নূর সৃষ্টি করেছেন, সে নূর থেকে অসংখ্য ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। সেসব ফেরেশতার উপর সারাক্ষণ তসবীহ-তাহলীল পাঠ এবং আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব পবিত্রতা বর্ণনার নির্দেশ রয়েছে। তারা এক পলকের জন্যও অমনোযোগী হলে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলার তাজাল্লীতে জ্বলে-পুড়ে ছাই-ভস্ম হয়ে যাবেন। সেসব ফেরেশতার কেউ গাভীর, কেউ সাপের এবং কেউ শকুনের আকৃতিবিশিষ্ট। আবার কারো কারো দেহের উপরের দিক বরফ এবং নীচের দিক আগুনের তৈরী। এদের সকলেই এই তসবীহ পাঠ করেন- “সুবহানা মান আল্লাফা বাইনাস সালজি ওয়াননার) অর্থাৎ, আমি তসবীহ পাঠ করছি সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে গঠন করেছেন বরফ ও আগুন দ্বারা। না বরফ আগুন নিভাতে পারে আর না আগুন বরফ গলাতে পারে। এসব ফেরেশতার কেউ দাঁড়ানো অবস্থায়, কেউ রুকুতে, কেউ সজদাতে, কেউ বসা অবস্থায় রয়েছেন। কেয়েমত পর্যন্ত এভাবে থাকবেন। কেয়ামতের দিন এসব ফেরেশতার সকলেই অক্ষমতা অপারগতা প্রকাশ করে বলবেন “হে আমাদের প্রভু পরওয়ারদেগার! আমরা যথাযথভাবে আপনার এবাদত করতে পারি নাই। এরপর আল্লাহ তাআলা সাত দিন সৃষ্টি করে রবিবার আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণকে, সোমবার সাত তবক আসমান, মঙ্গলবার সাত তবক জমিন, বুধবার অন্ধকার, বৃহস্পতিবার জমিনের কল্যাণ ও তন্মধ্যস্থ সব কিছু, শুক্রবার দিন চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করে এদিনই সাত আসমানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন এবং সপ্তম দিন অবসর নিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-(খালাকাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা ওয়ামা বাঈনাহুমা ফী সিত্তাতি আইয়্যামিন) অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা আসমান জমিন ও তন্মধ্যস্থ সব কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন।
“ওয়া ইন্না ইয়াওমান ঈন্দা রাব্বিকা কাআলফি সানাতিম মিম্মা তাউদদূন”। অর্থঃ- তোমাদের রবের নিকট একদিন তোমাদের গণনানুযায়ী এক হাজার বছরের সমান।
Related: ভূনা করা মাছ কিভাবে লাফিয়ে পড়ল জানতে ক্লিক করুন।
কোরআনের এ আয়াতের মর্মানুযায়ী পরকালের একদিন দুনিয়ার জীবনের এক হাজার বছরের সমান। এ থেকে বুঝা গেল, আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার জীবনের হিসাবানুযায়ী এক হাজার বছরের কাজ একদিনে করতে সক্ষম। সুতরাং তাঁর কুদরত রয়েছে, তিনি কয়েক হাজার সৃষ্টির সৃষ্টিকর্ম চোখের পলকে শেষ করতে পারেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্মে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে পরিপূর্ণ কৌশল প্রয়োগপূর্বক বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন নিজেদের কাজেকর্মে তাড়াহুড়া না করে বরং ধৈর্য অবলম্বন করে। কেননা, ধৈর্যই সাফল্যের চাবিকাঠি। এরপর আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সর্বনিম্নস্তর সৃষ্টি করেছেন, এর নাম তাহতাস সারা।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘সারা’ একটি সবুজ পাথরের নাম। এই পাথরের নীচেই জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে। জাহান্নামের এক সরদার রয়েছেন মালেক। জাহান্নাম তাঁর অধীনস্থ। ঊনিশ জন ফেরেশতা তৈরী করে তাঁদের সকলকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতা মালেকের অধীন করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- জাহান্নামে ঊনিশ ফেরেশতা রয়েছে। প্রত্যেক ফেরেশতার ডানে বামে সত্তর হাজার করে হাত রয়েছে, প্রতি হাতে সত্তর হাজার করে হাতের পাতা, প্রত্যেক পাতায় সত্তর হাজার করে আঙ্গুল এবং প্রতি আঙ্গুলের উপর সত্তর হাজার করে অজগর অবস্থিত রয়েছে। প্রতিটি অজগরের মাথায় রয়েছে একেকটি সাপ, যার প্রতিটির দূরত্ব সত্তর হাজার বছরের পথ। প্রতিটি সাপের সাপের মাথায় রয়েছে একটি করে বিচ্ছু। এই বিচ্ছু যদি কোন জাহান্নামীকে দংশন করে তাহলে ব্যথায় সত্তর হাজার বছর পর্যন্ত গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকবে। বাম হাতের প্রতি আঙ্গুলের উপর আগুনের একেকটি খুঁটি রয়েছে। সে খুঁটির একটিও যদি হাশরের মাঠে ফেলা হয় এবং জ্বিন ও মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টি মিলে সেটিকে হেলাতে চেষ্টা করে, তবুও সক্ষম হবে না।
জাহান্নামের সে ঊনিশ জন ফেরেশতার প্রতি হুকুম হল—তোমরা জাহান্নামে যাও। তখন তাঁরা নিবেদন করলেন—ইয়া আল্লাহ! জাহান্নামের আগুনের ভয়ে আমরা তথায় যেতে পারছি না। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশে জান্নাত থেকে একটি সীল নিয়ে জাহান্নামের সকল ফেরেশতার কপালে সীলমোহর মেরে দেওয়া হয় এবং সে সীলমোহরের উপর কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লেখা ছিল। এই সীলমোহর লাগানোর উদ্দেশ্য জাহান্নামের আগুন যেন ফেরেশতাদের উপর কোন ক্রিয় করতে না পারে। জাহান্নামের ঊনিশ ফেরেশতা কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সঃ) বরকতে জাহান্নামে প্রবেশ করছেন। প্রবেশকাল থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তাঁরা জাহান্নামে অবস্থান করবেন। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা—“উলায়িকা কাতাবা ফী কুলূবিহিমুল ঈমান”। অর্থাৎ, তারা সেসব লোক যাদের অন্তরে ঈমান লিপিবদ্ধ হয়েছে- এ আয়াতাংশের মর্মানুযায়ী যে মোমেনের কপালে ও অন্তরে মুহাম্মাদী কালেমার সীলমোহর থাকবে, কোণ অবস্থাতেই জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না। আর জাহান্নামের সাত স্তর রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন—অর্থাৎ, জাহান্নামের সাতটি স্তর রয়েছে এবং প্রটি স্তরের জন্য একেক দল বন্টিত হয়েছে। জাহান্নামের সাতটি আতর হল- জাহীম, জাহান্নাম, সাকার, সায়ীর, লাযা, হাবিয়া ও হোতামা।
Related: ইলুমিনাতি কি? এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
বর্ণিত আছে, একদিন হযরত জিবরাঈল (আঃ) হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর নিকট এ আয়াতের ওহী নিয়ে আসেন- উচ্চারণঃ- ফাখালাফা মিম বাদিহিম খালাফুন আজাউস সালাতা ওয়াত্তাবাউশ শাহাওয়াতি ফাসাওফা ইয়ালকাউনা গাইয়্যান।
আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে- অনন্তর তাদের পরে এমন বাজে লোক জন্ম নিল যারা নামাজ নষ্ট করে দিল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল, সুতরাং তারা অতি শীঘ্রই বিপদ দেখবে। জিবরাঈল (আঃ) যখন উল্লেখিত আয়াতের ওহী নিয়ে আসেন তখনই জমিন ও পাহাড়ে এক কম্পন সৃষ্টি হয়। সাথে সাথে এক বিকট শব্দ ভেসে আসে যাতে হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহেরা মোবারকের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই বিকট শব্দ কিসের এবং কোথা হতে এসেছে? তিনি বললেন- ইয়া হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)! আদম সৃষ্টির সাত হাজার বছর আগে থেকে সত্তর হাজার মণ ওজনের একটি পাথর জান্নামের কিনারায় পড়া ছিল। সে পাথরটি পনর হাজার বছর ধরে জাহান্নামের নীচের দিকে যেতে থাকে। এই মাত্র সেটি হোতামার গভীর তলদেশে গিয়ে ঠেকেছে। আপনার শ্রুত বিকট আওয়াজ উক্ত আওয়াজই বটে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞাসা করলেন- সেটা কাদের আবাসস্থল? জিবরাঈল (আঃ) বললেন- সেটা মোনাফেকদের আবাসস্থল। যেমন- আল্লাহ্ তাআলা বলেন- ‘ইন্নাল মুনাফিকীনা ফিদ্দারকিল আসফালি মিনান নার’। অর্থাৎ, নিশ্চয় মোনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করবে। জাহান্নামের ষষ্ঠ স্তরে মোশরেকরা, পঞ্চম স্তরে মূর্তিপূজারীরা, চতুর্থ স্তরে মদ বিক্রেতা, তৃতীয় স্তরে মিথ্যাবাদী, দ্বিতীয় স্তরে অস্বীকারকারীরা এবং প্রথম স্তরে আপনার উম্মতের গুনহগাররা অবস্থান করবে। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেন- “ইন্নাল্লাযীনা আমানূ ওয়াল্লাযীনা হাদূ ওয়াস সোআবিঈনা ওয়াননাসারা ওয়াল মাজুসা ওয়াল্লাযীনা আশরাকু”। অর্থাৎ, মোমেনদের মধ্যকার গুনাহগার, ইহুদী, সাবী (মূর্তি পূজারীদের একদল), নাসারা, অগ্নিপূজক এবং মোশরেক-এই ছয় দলের লোকেরা জাহান্নামে থাকবে। জাহান্নামের এক স্তর থেকে আরেক স্তর পর্যন্ত সত্তর বছরের রাস্তা।
হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ্র কুদরতে হাজার বছর পর্যন্ত জাহান্নামের আগুন জ্বালানো হলে তা লাল বর্ণ ধারণ করে। অতঃপর হাজার বছর জ্বালানো হলে তা সাদা বর্ণ ধারণ করে। তারপর হাজার বছর জ্বালানো হলে কাল বর্ণ ধারণ করে। কেয়ামত পর্যন্ত জাহান্নামের আগুন এই কাল বর্ণই থাকবে- যেমন অন্ধকার রাত। আর পাথরের একটি টুকরা জাহান্নামে রাখা হয়েছে, যেটি পাঁচশ’ বছরের পথ সমান চওড়া। সেটি কেয়ামত পর্যন্ত জাহান্নামের উপর থাকবে।
এরপর আল্লাহ্ তাআলা বালু সৃষ্টি করেন। তিনি নির্দেশ দিলে বাতাস সেই বালুর একাংশ জমিনের উপর এবং একাংশ নীচে নিয়ে যায়। পরক্ষণেই ধোঁয়াবিহীন আগুন সৃষ্টি করে তা হতে জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন- আমি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি এবং জ্বিনদের দ্বারা সারা জগত ভরে যায়। পরে আল্লাহ্ তাআলা তাদের নিকট ইউসুফ নামক এক নবী প্রেরণ করেন। আল্লাহ্ তাআলা সেই নবীকে শরীঅতের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন এবং তিনি জ্বিনদেরকে আল্লাহ্ তাআলার প্রতি আহবান জানাতে থাকেন। কিন্তু জ্বিনেরা তাঁর অনুগত্য না করে তাঁকে হত্যা করে এবং জগতে জুলুম-ফাসাদ ছড়াতে থাকে। তখন আল্লাহ্ তাআলা আযরাঈল (আঃ)-কে অন্যান্য ফেরেশতা সহ প্রেরণ করেন। তাঁরা জ্বিনদেরকে হত্যা করে সমগ্র জগত প্রাণী শূন্য করে ফেলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ)।
সূত্রঃ- কাসাসুল আম্বিয়া প্রথম খণ্ড