সাক্ষাতে হযরত খিযির (আঃ) পরিচয় জানতে চাইলে হযরত মুসা (আঃ) তাঁর পরিচয় ব্যক্ত করেন । তিনি বললেন– আমার নাম মুসা (আঃ) । হযরত খিযির (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কি বনী ইসরাঈলের মাঝে প্রেরিত আল্লাহর রাসুল ? মুসা (আঃ) হাঁ সূচক জবাব দেন । হযরত মুসা (আঃ) নিজের পরিচয় দেন এবং তথায় গমনের কারণ বিবৃত করেন । হযরত মুসা (আঃ) খিযির (আঃ) কে বলেন, আমি আপনার সাথে এই শর্তে থাকতে পারি কি যে, মহান রাব্বুল আ’লামিন কর্তৃক আপনাকে যে উপকারী এলেম শিখানো হয়েছে তা হতে আপনি আমাকেও শিখাবেন ।
হযরত মুসা ও খযির (আঃ) আলাপরত । এমন সময় তাঁদের সম্মুখে একটি পাখী এসে নদী হতে ঠোঁটে করে এক কতরা পানি উড়ে যায় । খিযির (আঃ) তাঁকে পাখীটির প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, আপনি তো মনে করে নিয়েছেন যে, আমি সর্বাপেক্ষা বেশী এলেমের অধিকারী । অথচ বণী আদমের এলেমের শুরু ও শেষ এবং প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবটাই আল্লাহর এলেমের তুলনায় পাখীটির ঠোঁটে ধারণকৃত সাগরের অথৈ পানিরাশির এক ফোঁটা ব্যতীত বেশী কিছু নয়; বরং তার চাইতেও কম । আল্লাহর এলেমের তুলনায় আমার আপনার এলেমের আর কি মর্যাদা আছে ।
ইলুমিনাতি সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
কথা হচ্ছে – আল্লাহ আপনাকে প্রশিক্ষণ দান করেছেন । কোন বিষয় আপনার জানা আছে আমার নাই, আবার কোন বিষয়ে আমি রয়েছি সে বিষয়ে হয় তো আপনি অবগত নন । এবার হযরত খিযির (আঃ) হযরত মুসা (আঃ) – এর তাঁর সাথে অবস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করেন । বললেন , আপনি তো আমার সাথে অবস্থান করে কিছুতেই ধৈর্য ধারণে সক্ষম হবেন না । আর সে বিষয়ে আপনি কি ভাবে ধৈর্য অবলম্বন করবেন যে বিষয়ে আপনি অবহিত নন । সুতরাং আপনি আমার সঙ্গে অবস্থান করতে চাইলে কোন অবস্থাতেই কোন বিষয়ে আপনি আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না । কেননা আধ্যাত্মিক বিষয়াদি সম্পর্কে অবগতি লাভ অনেক দরূহ ব্যপার হয়ে থাকে ।
খিযির (আঃ) -এর উল্লিখিত আলোচনা ও শর্তের জবাবে হযরত মুসা (আঃ) বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন । মুসা (আঃ) – এর জবাবে হযরত খিযির (আঃ) বললেন, দেখুন! আপনি রাসুলের পদমর্যাদায় সমাসীন । আর রাসুলের দায়িত্ব হল মানুষকে আল্লাহর কিতাবের বিধি বিধানের শরীঅত শিক্ষাদান । আর শরীঅতের এলেম সমগ্রটাই বাহ্যিকতার উপর ভিত্তিশীল । বাহ্যিকতাই শরীঅতের যাবতীয় কর্মকান্ডের ভিত্তি । তাই আমার সঙ্গে অবস্থানকালে আমার এমন সব কাজকর্ম আপনার চোখে পড়বে যা শরীঅতের পরিপন্থী বলে মনে হবে । তাই আপনি ধৈর্য অবলম্বন করতে পারবেন না । ফলে প্রশ্ন উত্থাপন করে বসবেন । কেননা, শরীঅত পরিপন্থী কাজ দেখে আপনার হয়রান পেরেশান হওয়াটাই স্বাভাবিক । কারণ, শরীঅতের বিধান মতে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা ফরয । সুতরাং বাহ্যত আমার শরীঅত পরিপন্থী কাজকর্ম দর্শনে তাতে বাধা দেওয়া ফরয দায়িত্ব ভেবে আপনি ধৈর্য অবলম্বন করতে সক্ষম হবেন না ।
অথচ আমি আল্লাহর পক্ষে থেকে আদিষ্ট হয়ে বাহ্যত শরীঅত সম্মত নয় এমন কাজ করতেও বাধ্য থাকব । তাই প্রশ্ন উত্থাপন ব্যতীত ধৈর্যাবলম্বন আপনার জন্য খুবই কঠিন হবে । অবশ্য বাহ্যত শরীঅত পরিপন্থী কাজ দর্শনে আপনি যদি প্রশ্ন উত্থাপন করেই বসেন , তবে সে জন্য আপনাকে কোন প্রকারে অভিযুক্তও করা হবে না । মুসা (আঃ)- এর একই জবাব– ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন । কোন ব্যপারেই আমি আপনার নির্দেশের বিপরীত কিছু করবো না ।
প্রকাশ্যত শরীঅতের পরিপন্থী বলে মনে হলেও হযরত মুসা (আঃ) হযরত খিযির (আঃ)- এর কোন কাজে প্রশ্ন খতুলতে পারবেন না যতক্ষণ না তিনি স্বয়ং বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করেন । হযরত মুসা (আঃ) এ শর্তে পুরোপুরি মেনে চলবেন বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করলে উভয়ে সাগর পাড়ের পথ ধরে সম্মুখে অগ্রসর হতে শুরু করেন । কিছু দু্র গিয়ে তাঁরা একটি নৌকা দেখতে পান । খিযির (আঃ) নৌকায় আরোহণ করে কোথাও গমনের ইচ্ছায় মাঝিদের সাথে কথাবার্তা বলেন । তারা খিযির (আঃ) -কে নিয়ে নৌকায় আরোহণ করে । নৌকায় আরোহণ করেই হযরত খিযির (আঃ) কুড়ালের আঘাতে নৌকার একখানা তক্তা ভেঙ্গে ফেলেন । এ কান্ড দর্শনে হযরত মুশা (আঃ)- এর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় । তিনি আপত্তি উত্থাপন করে বসলেন– নৌকার মাঝিমাল্লা বেচারারা বিনা ভাড়ায় নৌকায় উঠিয়ে আপনার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছে । আর আপনি খামাখাই তাদের নৌকাখানা ভেঙ্গে দিলেন । কারো অনুগ্রহের বিনিময়ে এটা তো কোন ভাল কাজ হলো না । মুসা (আঃ) এর আপত্তিতে হযরত খিযির (আঃ) বললেন, আপনি তো আমার সাথে অঙ্গীকারাব্ধ হয়েছেন যে, কোন ব্যপারে আমাকে প্রশ্ন করবেন না । আমার কোন কাজে আপত্তি উত্থাপন না করে ধৈর্য ধারণ করবেন যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমি কিছু আলোচনা করি। এখন তো প্রথম বারেই আপনি কৃত অঙ্গীকার ভুলে বসেছেন । মুসা(আঃ) অনুধাবন করলেন – আসলেও তো এতে তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ হয়েছে । তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন–ভুল হয়ে গেছে । আমি আর আপনার কোন কাজে প্রশ্ন উত্থাপন করব না । সুতরাং এ ব্যপারে আমাকে অভিযুক্ত করবেন না ।
হযরত খিযির (আঃ) নৌকা ছিদ্র করে দেওয়ার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে একধিক বর্ণানা রয়েছে । এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি ছিদ্র করে দেওয়ার পরও নৌকায় পানি প্রবেশ করে নাই । আরেক বর্ণনায় রয়েছে, ছিদ্রকৃত অংশ তিনি আয়না দ্বারা মেরামত করে দিয়েছিলেন, তাই নৌকায় পানি প্রবেশ করতে পারে নাই । অথবা এটা খিযির (আঃ) -এর কারামতও হতে পারে । নৌকায় ছিদ্র করে দেওয়ার পর হযরত মুসা (আঃ) এর আপত্তি উত্থাপন এবং খিযির (আঃ) এর অভিযোগের আপাতত পরিসমাপ্তি ঘটে । মুসা (আঃ) নিজের ভুলের জন্য ওজর পেশ করেন ।
দাজ্জাল কেন আসবে দুনিয়াতে জানতে ক্লিক করুন।
এবার উভয়ে নৌকা থেকে অবতরণ করে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। নদীর পার ধরেই চলছেন। কিছু দুর যাওয়ার পর তাঁরা একটি অত্যন্ত সুন্দর বালককে অন্যদের সঙ্গে খেলায় মত্ত দেখতে পান। হযরত খিযির (আঃ) বালকটিকে ধরে দেহ হতে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন । মুসা (আঃ) দেখলেন , বর্তমান ঘটনা পূর্বের ঘটনার চাইতেও মারাত্মক । রীতিমত নিরপরাধকে হত্যা । তাও একটি নিষ্পাপ বালক । পূর্বের ঘটনায় তো নৌকারোহীদের নিমজ্জন এবং আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল । আর এক্ষেত্রে তো আরো মারাত্মক ঘটনা ঘটানো হয়েছে । একটি অবোধ নিরপরাধ বালককে শুধু শুধুই হত্যা করা , এটা কনো সুস্থ বিবেক সমপন্ন মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে পারে না। তিনি খিযির (আঃ) কে অভিযুক্ত করে বললেন– আপনি শুধু শুধুই এক অবোধ নিষ্পাপ বালককে হত্যা করলেন। এটা তো আপনি খুবই খারাপ কাজ করেছেন। হযরত খিযির (আঃ) এ অভিযোগের জবাবেও বললেন, আমিতো আগেই বলেছিলাম যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। মুসা (আঃ) বললেন, এর পর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করি তবে আমাকে আপনার সাথে রাখবেন না । অবশ্যই আপনি আমার পক্ষ হতে আপত্তির শেষ সীমায় উপনীত হয়েছেন ।
হযরতখযির (আঃ) তাঁর এ আপত্তি গ্রহণ করেন এবং সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকেন । চলতে চলতে তাঁরা এক লোকালয়ে এসে উপনীত হন । হযরত সিরীন (রঃ) এর বর্ণনা মতে এ লোকালয়ের নাম আইকা। যাক, তাঁরা লোকালয়ে উপনীত হয়ে সেখানকার অধিবাসীদেরকে বললেন, আমরা ভিন দেশী মুসাফির। তোমাদের অনাত্মীয় মেহমান । সুতরাং তোমরা আমাদের মেহমানদারীর ব্যবস্থা গ্রহণ কর । আমাদেরকে খেতে দাও। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরা খিযির (আঃ) এর এ আহবানে সারা দেয় নাই । অগত্যা ক্ষুদার্ত অবস্থায়ই তাঁদেরকে রাত কাটাতে হয় । অতি ভোরে তাঁরা লোকালয় ত্যাগ করার সময় হযরত খিযির (আঃ) দেখলেন, একটি বাড়ির সীমানা প্রাচীর পতনোন্যুখ হয়ে ঝুঁকে আছে। তিনি হাতের ইশারায় প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন।