Photo: Television
আজকের আধুনিক টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে বলতে আমরা যা বুঝি, তার প্রথম প্রবর্তন হয়েছিল ইংল্যান্ডে ১৯২৭ সালে। আবিষ্কর্তার নাম জন লোগি বেয়ার্ড। ভদ্রলোক ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। বেয়ার্ড অবশ্য প্রথমে খুব দূরে কোন মানুষ বা কোন দৃশ্যাবলীকে প্রেরণ করতে সমর্থ হননি।
টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে
প্রথম যে পরীক্ষাটি দেখিয়েছিলেন তখন দূরত্বটা ছিল কয়েকশ গজ মাত্র। তাঁর পরীক্ষার জায়গা থেকে কিছু দূরে একটি ঘরের মধ্যে দর্শকদের বসিয়েছিলেন। দর্শকদের সামনে ছিল একটা যন্ত্র ও একটা পর্দা। তারপর পরীক্ষাগারে চলে যান। এক সময় দর্শকরা দেখতে পায় সিনেমার পর্দার মত সচল মানুষের মূর্তি। সেদিন সত্য সত্যই বিস্মিত হয়েছিলেন দর্শকরা এবং Television আবিষ্কারের গৌরবও লাভ করেছিলেন বেয়ার্ড।
অতঃপর ঐ বেয়ার্ডই গবেষণার মাধ্যমে টেলিভিশনের আরও উন্নতি করেন। ফলে দূরত্বকে আরও কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হন। অতঃপর মার্কিন বিজ্ঞানী জোরকিন বেয়ার্ডের পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। আর জোরকিনের পদ্ধতি অবলম্বন করেই আমেরিকার রেডিও কর্পোরেশন প্রথম টেলিভিশন প্রদর্শনের সূচনা করে। আজকের টেলিভিশন ঐ পদ্ধতিরই উন্নত রূপ।
Related: টেলিফোন আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
জন লোগি বেয়ার্ড ছিলেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গরিব ছাত্র। সর্বপ্রথম নিজের সক্ষমতার বাইরের এই কয়টি ব্যাপার নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে লাগলেন। এই দরিদ্র ছেলেটি স্কটল্যান্ডে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
Photo: Sony TV
টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে ? ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৭৩ সালে বিজ্ঞানী মে ও স্মিথ ব্রিটিশবিজ্ঞানী জন লোগি বেয়ার্ড ১৯২৬ সালে প্রথম Television আবিষ্কার করেন এবং সাদা কালো ছবি দূরে বৈদ্যুতিক সম্প্রচারে পাঠাতে সক্ষম হন। এরপর রুশ বংশোদ্ভুত প্রকৌশপ্লী আইজ্যাক শোয়েনবারগের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি। টেলিভিশন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হয় ১৯৪০ সালে। অতপর ১৯৪৫ সালে যন্ত্রটি পূর্ণতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়। গত শতাব্দীর ৫০ এর দশকে টেলিভিশন গণ্মাদ্ধ্যমের ভূমিকায় উঠে আসে। শুরু হয় টেলিভিশনের নব জাগরণ।
বিশেষজ্ঞদের আলাপ-আলোচনায় কে টিভি আবিষ্কার করেছেন, সেটা নিয়ে কিছুটা বিতর্কের আভাস পাওয়া যায়। আসলে টেলিভিশন আবিষ্কারের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। পল নিপকো নামের এক বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন স্ক্যানিং ডিস্ক। আর এই স্ক্যানিং ডিস্কের উপর ভিত্তি করে তিনি পৃথিবীর প্রথম টিভি বানানোরও চিন্তা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর নকশা অনুযায়ী যন্ত্রটা আর বানাতে পারেন নি।
১৯৭০ সালে লি লিফরেস্ট ও আর্থার কর্ন আরেকটা নকশা তৈরি করেন। সে অনুযায়ী একটি যন্ত্রও বানান। সেখানে পাঠানো ছবিকে রিসিভ করার পর অ্যামপ্লিফায়ার দিয়ে আবার বড়ো করারও ব্যবস্থা রাখেন। কিন্তু তাদের যন্ত্রে চলমান ছবি দেখানোর ব্যবস্থা ছিল না।
Related: ট্রানজিস্টর এর কাজ কি এবং ট্রানজিস্টর কিভাবে সুইচিং হিসেবে কাজ করে।
একই সমস্যা ছিল ভল্যাদিমির জোয়ার্কিন ও তার শিক্ষক বোরিস রোজিংয়ের টিভিতেও। অবশ্য তারা আরও উন্নত স্ক্যানার ব্যবহার করেন। তৈরি করেন ব্রাউন টিউব। এখনও পেট মোটা টিভিগুলোতে (সি আর টি টিভি) এরকম একটি টিউব ব্যবহৃত হয়। তাদের স্ক্যানার আগের টিভিগুলোর চেয়ে উন্নত হলেও তা চলমান ছবি দেখানোর মতো ভালো ছিল না। এবার দৃশ্যপটে হাজির হলেন জন লোগি বেয়ার্ড। ১৯২৫ সালে ২৫ মার্চ তিনি নতুন একটি টিভির সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এটার স্ক্যানার ছিল আরও ভাল। প্রতি সেকেন্ডে ৫টা করে ছবি দেখা যেতো এটা দিয়ে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এটাও চলমান ছবি দেখাতে পারেনি। কারণ, ছবিকে চলমান মনে হওয়ার জন্য প্রতি সেকেন্ডে ১২টা ছবি পরিবর্তিত হতে হয়। তাহলে মনে হয় এটা চলমান বা ভিডিও। খুব অবাক হচ্ছো, ভাবছো, ভিডিও তো ভিডিওই, স্থির ছবি আবার ভিডিও হয় কিভাবে ? আসলে ভিডিও অনেকগুলো স্থির ছবির সমষ্টি। অনেকগুলো স্থির ছবি যখন একসঙ্গে খুব দ্রুত দেখো, তখন তোমার চোখ আর আলাদা করে স্থির ছবিগুলোকে দেখতে পারেনা। ওগুলো একসঙ্গে একটি চলমান ছবি বা ভিডিও হয়ে যায়।
২ অক্টোবর বেয়ার্ড ইতিহাসের প্রথম টিভি নিয়ে হাজির হলেন সবার সামনে। এটাতে প্রতি সেকেন্ডে ১২.৫টা করে ছবি দেখা যেতো। অর্থাৎ প্রথম বারের মতো টিভির মাধ্যমে চলমান প্রোগ্রাম দেখানো সম্ভব হলো। শুরু হলো পৃথিবীতে টেলিভিশন অধ্যায়। তাহলে এবার হলো তো, টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে এবং কবে আবিষ্কার করেন? হ্যা, জন লোগি বেয়ার্ড, ১৯২৫ সালে টিভি আবিষ্কার করেন।
Photo: Television Old
বেয়ার্ড মূল যে যন্ত্রটির সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, সেটির নাম ফটো ইলেকট্রিক সেল। গোটা ছবিটাকে সরাসরি চালান করার চেষ্টা না করে ছবিকে বা কোন দৃশ্যকে কতকগুলো ভাগে ভাগ করেছিলেন। ছবি বা দৃশ্যের কোন বিন্দুতে আলো ফেলে যদি সে আলোককে ফটো ইলেকট্রিক সেলে পাঠানো যায়, তাহলে সেই বিন্দুর আলো তার ক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহে রুপান্তরিত হবে। এই সত্যকে কাজে লাগিয়ে বেয়ার্ড সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট একটা গোলাকার ধাতব চাকতিকে ব্যবহার করেছিলেন। সেই চাকতিটিকে আবার ছবির উপর রেখে অতি দ্রুত ঘোরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আর্কল্যাম্প থেকে আগত আলোকরশ্মিকে লেন্সের সাহায্যে চাকতির উপর ফেলেছিলেন। সেই আলো চাকতির ছিদ্রপথে গিয়ে ছবির উপর পড়েছিল।
যেহেতু চাকতিটিকে অতি দ্রুত ঘোরাবার ব্যবস্থা ছিল এবং ঘোরাবার এমন ব্যবস্থা ছিল যে আলো ছবির উপর প্রতিটি ছিদ্রএর ভেতর দিয়ে ক্রমিক পর্যায়ে পর পর গোটা ছবিটাকে আলোকিত করেছিল। ছবির বিভিন্ন বিন্দু থেকে যে আলো নির্গত হয়েছিল, তার পরিমাণ ছিল বিভিন্ন। কম শক্তির আলো ফতো ইলেকট্রিক সেলে কম শক্তির বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিলেবং বেশি শক্তির আলো সৃষ্টি করেছিল বেশি শক্তির বিদ্যুৎ প্রবাহ। ভিন্ন ভিন্ন শক্তিসম্পন্ন সেইসব বিদ্যুতস্পন্দনের পর চাপিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ। আর এখানেও ব্যবহার করা হয়রছিল প্রেরক যন্ত্র, আকাশ তার এবং মাইক্রোফোন। দৃশের সঙ্গে সঙ্গে গানবাজনা কিংবা কথাকে প্রেরণ করার জন্য বেয়ার্ড দ্বিতীয় একটি প্রেরক যন্ত্র, একটি আকাশতার এবং একটি মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন।-ঠিক সেই প্রেরক যন্ত্রের মতোই।
একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল গ্রাহক যন্ত্রের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে যে আকাশতারের ব্যবস্থা ছিল তাতে ধরার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রেরক যন্ত্র কর্তৃক প্রেরিত মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ। এখানকার প্রধান কাজ ছিল মিশ্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ থেকে কম ও বেশী শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহকে পৃথক করে নেওয়া এই উদ্দেশ্যে বিদ্যুতপ্রবাহকে বিশেষ একধরণের বায়ুশূন্য টিউবের ভেতর দিয়ে চালনা করা হয়েছিল।
Related: মাধ্যাকর্ষণ বল কাকে বলে ?
প্রেরক যন্ত্রের মত গ্রাহকযন্ত্রে একটি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্রবিশিষ্ট ধাতব চাকতিকে ঘোরাবার ব্যবস্থা ছিল। টিউব থেকে আলোকরশ্মি এখানেও চাকতির ছিদ্র পথে চালিত হয়ে পূর্বের মত পরপর ক্রমিক পর্যায়ে পর্দার উপর পড়েছিল। গান ও কথাকে শোনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল বেতার গ্রাহকযন্ত্র, আকাশতার ও মাইক্রোফোন।
জোরিকিনের পদ্ধতিতে প্রেরকযন্ত্রে ফটো ইলেকট্রিক সেলের পরিবর্তে ইকনোস্কোপ নামে আর একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়রছিল। বর্তমানে উক্ত পদ্ধতিকেই অনুসরণ করা হয়, তবে উন্নত হয়েছে অনেকখানি। এখন অবশ্য বেয়ার্ডের সেই টিভি আর নাই। সেই টিভি ছিল সাদাকালো। এখন তো রঙিন টিভি ছাড়া কোনো কথাই নেই। আর টিভিরও কতো যে রূপান্তর ঘটেছে।
Photo: Television with Library
পুষ্টির অভাবে দুর্বল হওয়া সত্যেও প্রচন্ড উৎসাহের সঙ্গে বেতারে ছবি ধরার কাজটা নিয়ে তিনি উঠেপড়ে লাগলেন। টেলিভিশনের উন্নতি সম্ভব হয়েছে অর্থিকন, ইমেজ অর্থিকন,টিভিকন প্রভৃতি যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। উক্ত যন্ত্রগুলি ব্যবহারের ফলে ছবি বা দৃশ্যের সুস্পষ্ট রূপতো পাওয়া যায়ই, অধিকন্তু, স্বাভাবিক রঙও দেখা যায়। তবে, টেলিভিশন কেন্দ্র থেকে গ্রাহক যন্ত্রের দূরত্ব ছবি অস্পষ্ট হয়ে উঠে। এর কারণ প্রেরক যন্ত্র থেকে ১০ সেন্টিমিটারের কম তরঙ্গ দৈর্ঘের হ্রস্বতরঙ্গের মিশ্র বিদ্যুতস্পন্দনের সৃষ্টি করা হয়। হ্রস্ব তরঙ্গের অসুবিধা অনেক। সাধারণত আয়নমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়ে এগুলি খুব বেশী দূরে যেতে পারে না। তাই রিলে ব্যবস্থা করতে হয়। এই কাজে বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহদের নিয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছে।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে, পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। পরবর্তীতে সরকারিভাবে ১৯৬৮ সালে রাম্পুরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৬ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রথম ঢাকার বাইরে টিভি সম্প্রচার শুরু হয়। প্রথম দিকে বাংলাদেশে শুধু ধনী ও উচ্চবিত্তের ঘরে Television দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ ঘরেও টিভি দেখা যায়। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিটিভি ছাড়াও এখন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেল-এ অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সব শেষে আমারা জানতে পারলাম টেলিভিশন কি এবং টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে ?
প্রথম পর্বঃ টেলিভিশন আবিষ্কার করেন কে – ১ম পর্ব।
সুত্রঃ বিজ্ঞানীদের জীবনি আবিষ্কারের কথা।