প্রথম পর্ব থেকে আমরা ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছি। এবার পরবর্তি পর্ব। প্রথম পর্ব পরে না থাকে নিচের লিঙ্ক থেকে পরে আসতে পারেন।
প্রথম পর্বঃ ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ১ম পর্ব
মোমবাতি ঘড়ি ( candle clock )
প্রচীনকালে চীনে একধরনের ঘড়ির প্রচলন হয়েছিল। একটি দড়িতে সমান দুরত্বে কয়েকটি গিট দেওয়া হতো। এরপর দড়ির এক প্রান্তে আগুন জ্বালিয়ে দিলে আস্তে আস্তে দড়িটি পুড়তে শুরু করতো। একটি গিট থেকে পুড়ে অন্য গিট পর্যন্ত পৌঁছতে কত সময় লাগছে তা থেকে সময় নির্ণয় করা হতো। এরপর মোমবাতি আবিষ্কারের পর থেকে সময় নির্ণয়ে মোমবাতির ব্যবহার শুরু হয়। মোমবাতি ঘড়িতে ১২ ইঞ্চি লম্বা ৬টি মোমবাতি পাশাপাশি রাখা হয়। প্রত্যেকটি মোমবাতি সমান পুরুত্বের হত এবং তাদের গায়ে প্রতি ১ ইঞ্চি অন্তর অন্তর দাগ কাটা থাকতো। প্রতিটি মোমবাতি চার ঘন্টা জ্বলত। তাই মমবাতির গায়ে কাটা প্রতিটি দাগ ২০ মিনিট প্রদর্শন করত। একটি নির্দিষ্ট আকৃতির মোমবাতি পুড়ে শেষ হতে কত সময় লাগছে তা থেকে সময় নির্ণয় করা হতো। মমবাতির গায়ে বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে সময় নির্দেশক দাগ দেওয়া হতো। পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরণের ঘড়ি ব্যাপক প্রচলিত ছিল।
জলঘড়ি ( water clock )
অতীতে সময় নির্ণয়ের আরেকটি পন্থা হলো জলঘড়ি। একটি ছোট নলের মাধ্যমে পানি এক চৌবাচ্চা থেকে অন্য চৌবাচ্চায় প্রবাহিত করা হতো। এই প্রবাহিত পানির পরিমাণের উপর নির্ভর করে সময় গণনা করা হতো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রচীনকালে সূর্যঘড়ির পাশাপাশি প্রচলন ছিল জলঘড়ির। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনদেশে জলঘড়ি বা Clepsydra -এর প্রচলন ছিল। অনেকে আবার মনে করেন মিশরে এই ঘড়ির প্রথম প্রচলন হয়। কারণ, প্রমাণ পাওয়া গেছে, প্রাচীন সভ্যতার শেষের দিকে মিশরীয়রা এই ওয়াটার ক্লকের প্রচলন শুরু করেছিল।
জল ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ?
জলঘড়ির গঠনও ছিল সরল আকৃতির। প্রথমে একটি পাত্রে পানি রাখা হতো। এই পত্রটির নীচে থাকতো একটি ফুটো। এই ফুটো দিয়ে নিচের আরেকটি পাত্রে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তো। নিচের পাত্রটিকে ২৪ ভাগে ভাগ করা থাকতো। নিচের পাত্রটিতে কতটুকু পানি জমা হলো তা থেকে নির্ণয় করা হতো সময়। এছাড়াও ভারত মহাদেশে আরেক ধরণের জলঘড়ির প্রচলন ছিল। এটিতে একটি বড় পানি ভর্তি পাত্রের উপর একটি ছোট ফুটোযুক্ত ধাতব পাত্র ভাসিয়ে দেওয়া হতো। ছোট পাত্রটি ভারি হওয়ায় তাতে আস্তে আস্তে পানি প্রবেশ করতো। এই ছোট পাত্রটির ভিতরের দিকে ঘন্টা নির্দেশক দাগ দেওয়া থাকতো। এই দাগ থেকে সময় নির্ণয় করা হতো। পরে খাঁজকাটা চাকা যুক্ত জলঘড়িও প্রচলন হয়।
প্রাচীন ইরানে ওয়াটার ক্লক ব্যবহার হত কৃষি কাজে এবং ঋতুর হিসাব রাখার জন্য। তাদের ওয়াটার ক্লক ছিল প্রাচীন গ্রীস সভ্যতায় ব্যবহৃত ওয়াটার ক্লকের থেকে ভিন্ন। সে সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বছরের বড় দিন ও ছোট দিন নির্ণয়ে সমর্থ হয়েছিল। বছরকে বিভিন্ন ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছিল পারস্য শাসন আমলেই। পৃথিবীর বহুদেশে এই জলঘড়ি জনপ্রিয়তা পায়। এটিতে সূর্যঘড়ির মত অসুবিধা ছিল না, ফলে এটি দিনে-রাতে ব্যবহার করা যেত ও যেকোন স্থানে বহন করা যেত। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে এই ঘড়ি ব্যবহৃত হতো। আমদের দেশে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য শহরেও জলঘড়ি ও সূর্যঘড়ির প্রচলন ছিল। তবে এত সুবিধা থাকার পরেও জলঘড়ির কিছু অসুবিধা ছিল। এই ঘড়ি জাহাজে ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া শীতপ্রধান দেশগুলোতে এ ঘড়ি ছিল অচল। কারণ এ ঘড়ির পানি জমে বরফে পরিণত হলেই ঘড়ি বন্ধ হয়ে যেত। ফলে মানুষ এই জলঘড়ির বিকল্প খোঁজা শুরু করে।
ঘড়ির আধুনিক সংস্করণ
অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি (Astronomical Watch)
১১ শতকে চীনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী হরলজিস এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সু সং একত্রে কাজ করে পানি চালিত একটি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি তৈরী করেন তাদের শহরের কেন্দ্রে স্থাপন করার জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুরোপুরি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরী প্রথম ঘড়ি হচ্ছে ক্লক ( clock )। তাহলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন এই ঘড়ী তৈরীতে অনেক কারিগরের অবদান রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন গ্রীক পদার্থবিদ আর্কিমিডিস খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দে প্রথম ক্লক আবিষ্কার করেন। তিনি চাকাযুক্ত ঘড়ি তৈরী করেন। সর্বপ্রথম গির্জাগুলোতে এ ধরণের ঘড়ির প্রচলন হয়। এসব ক্ষেত্রে ভারি কোনো বস্তুকে একটি চাকার সাথে যুক্ত করা হতো। ফলে মহাকর্ষ শক্তির টানে চাকাটি ঘুরতে চাইতো। কিন্তু চাকার এই ঘুর্ণনকে বিশেষ কৌশলে নিয়ন্ত্রন করা হতো যাতে চাকাটি ধীরে ধীরে ঘুরে। এই চাকার সাথে লাগিয়ে দেওয়া হতো সময় নির্দেশক কাঁটা। পরে এ ধরণের ঘড়িতে ডায়ালের প্রচলন শুরু হয়। ১২০৬ সালে মুসলমানজ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-জাহেরি নামাজ ও রোজার সময় সঠিক ভাবে নির্ণয় করার জন্য পানি চালিত অন্য একটি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি তৈরী করেন যাতে একবার পানি পূর্ণ করে দিলে ঘড়ি অনেক দিন এমনকি এক বছরও চলত।
ম্যাকানিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি (Mechanical Astronomical Watch)
১৪৬২ সালে Prague Astronomical Clock নামে একটি ঘড়ি তৈরী করা হয় যার মধ্যে বিভিন্ন সাইজের গিয়ার বক্স সংযুক্ত করা হয়েছিল। এই ঘড়িতে সর্বপ্রথম ঘন্টা, মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটা সুক্ষ ব্যবহার করা হয়। ১৪ শতকের দিকে ম্যাকানিক্যাল ঘড়ি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। ১২৮৮ সালে ওয়েস্ট মিনিস্টার হলে এবং ১২৯২ সালে ক্যান্টাবেরি ক্যাথিড্রালে এই ধরণের ঘড়ি বসানো হয়। মধ্যেযুগে ক্লকের প্রচলন অনেক বেড়ে যায়। তবে এদের কোনটাই সঠিক সময় দিত না। ম্যাকানিক্যাল ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ? ১৩৬৪ সালে ফ্রান্সের রাজা পঞ্চম চার্লস একটি ঘড়ি নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেন। ১৫ বছর পর এ ঘড়ি নির্মাণ শেষ হয়। বিখ্যাত ঘড়ি নির্মাতা করেন। এটাই সে যুগের সবচেয়ে আধুনিক ঘড়ি।
দোলক ঘড়ি (Pendulum Clock)
নিখুঁত সময় নির্ণয়ের জন্য এরপর মানুষ ঘড়ি তৈরীতে স্প্রিংয়ের ব্যবহার শুরু করে। ফলে ঘড়িগুলোর আকার অনেক কমে আসে। ষোল শতকে ইউরোপে নবযুগের সূচনা হয়। এ সময় ঘড়ির অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়। এরপর বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও প্রথম দোলকের ধর্ম সম্পর্কিত সূত্র আবিষ্কার করেন। যা পরবর্তীতে ঘড়িতে ব্যবহৃত হয়। ফলে আমরা পাই দোলকযুক্ত ঘড়ি। পরে আঠারো শতকে ঘড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে আরো অনেক উন্নয়ন ঘটে। দোলক ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ? ১৫৮০ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও দোলক আবিষ্কার করেন। তখন তিনি দোলকের দোলনকালকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম দোলক ঘড়ির থিওরি দাড় করান। তাঁর থিওরিকে কাজে লাগিয়ে ডাচ বিজ্ঞানী সি. হাইজেনস সর্বপ্রথম দোলক ঘড়ি তৈরী করেন।
১৬৭৩ সালে ওলন্দাজ গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স একটি ঘড়ি তৈরী করেন যা হলো দোলক ঘড়ির একটি উন্নততর সংস্করণ। দোলক ঘড়ি বব বৃত্তীয় বক্রপথে দোলে। এজন্য এই ঘড়ির দোলন-কম্পাঙ্ক তার দোলন-বিস্তারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। যত বেশী বিস্তারে দুলতে দেওয়া হয়, কেন্দ্রে ফেরত আসতে ববের তত বেশী সময় লাগে। ববটি যদি একটি সাইক্লয়েডীয় বক্রপথে দুলতো, তাহলে আর এই সমস্যাটি থাকতো না। কারণ সাইক্লয়েডের বৈশিষ্ট্য হলো, এর উপরকার যে কোন দুটি বিন্দু হতে মহকর্ষের প্রভাবে কেন্দ্রে গড়িয়ে আসতে কোন বস্তুর একই পরিমাণ সময় লাগে। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস সমুদ্র-সমতলে নিখুঁতভাবে দ্রাঘিমাংশ পরিমাপ করার প্রয়োজনে এমন একটি দোলক ঘড়ি তৈরী করেন যার ববটি একটি সাইক্লয়েডীও বক্রপথে দোলে। তাঁর নামানুসারে এই ঘড়ির নাম দেওয়া হয় হাইগেনের ঘড়ি। তিনি ববটিকে সূক্ষ্ম সুতার সাহায্যে ঝুলিয়ে দেন এবং দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য সুতাকে কেন্দ্রে রেখে দুই পাশে দুইটি সাইক্লয়েড আকৃতির দন্ড সংযোজন করেন। ফলে দোলেনের সময় যেকোন পাশে ববটি যখন কেন্দ্র থেকে দূরে সরতে থাকে, সুতাটি একটু একটু করে সাইক্লয়েড আকৃতির দন্ডের সংস্পর্শে আসতে থাকে, যার দরুন ববের অনুসৃত গতিপথটি হয় সাইক্লয়েডীয়।
পকেট ঘড়ি (Pocket Watch)
ঘড়িতে ঝুলন্ত ভারি বস্তু ব্যবহারের চলন উঠে যাওয়ার পর পকেটে বহনযোগ্য ছোট ঘড়ি তৈরি হয়। এগুলোই ‘ওয়াচ’ নামে পরিচিত। এটাই আমাদের বর্তমান যুগের ঘড়িগুলোর আদিরূপ। এ ধরণের ঘড়িগুলো গোলাকার ডিম আকৃতির ছিল। এজন্য এগুলোকে বলা হতো ‘ নুরেমবার্গের ডিম ‘। একটি ডিম্বাকৃতি কেসের মধ্যে ঘড়ির সব যন্ত্রাংশকে রাখা হতো। পকেট ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ? ১৬৭৫ সালে ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এবং রবার্ট হোক সর্বপ্রথম পকেট ঘড়ি তৈরি করেন। এই ঘড়িতে একটি প্যাঁচানো স্প্রিং ব্যবহার করা হয়। তৈরি করার পর পর সারা পৃথিবীতে এই পকেট ঘড়ির ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হয় এবং সর্বস্তরে ব্যবহার করা শুরু হয়। পরবর্তীতে এ ধরনের ওয়াচের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। ফলে জীবজন্তু, ফুল, বই , ঝিনুক প্রভৃতি আকৃতির ঘড়িও তৈরি হতে থাকে। দিনে ঘড়িতে অনেক দামী দামী যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হতো। ঘড়ির অলংকরণের জন্য মুক্তা, হীরা ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে ঘড়িতে কমদামী ‘ জুয়েল ‘ -এর ব্যবহার শুরু হয়। ফলে কমতে থাকে ঘড়ির দাম । ঘড়ি হয়ে উঠে সহজ লভ্য।
হাত ঘড়ি
১৫৭১ সালে Robert Dudley সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ-১ কে একটি উপহার দেন। প্রথম দিকে হাত ঘড়িছিল শুধুমাত্র মেয়েদের ব্যবহার করার জন্য। ছেলেদের জন্য পকেট ঘড়ি। তাছাড়া মিলিটারি সৈন্যদেরও হাতঘড়ি ব্যবহার করার ডকুমেন্ট পাওয়া যায়।
সর্বপ্রথম হাত ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন তার সঠিক ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি। তবে অনেকের মতে ১৫২৪ সালে, পিটার হেনেলিন প্রথম পকেট ঘড়ি তৈরি করেছিল। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে, অধিকাংশ ঘড়িই ছিল পকেট ঘড়ি যা শেকলের মাধ্যমে পকেতের সাথে আটকে রাখা হত। ১৯৭০ পূর্বে, সমস্ত ঘড়িতে একটি ঘুর্ণায়মান ঘন্টার কাঁটা এবং একটি দীর্ঘতর মিনিটের কাঁটার সঙ্গে একটি নম্বরযুক্ত ডায়াল ছিল। ১৯৭৭ থেকে ডিজিটাল ঘড়ি বাজারে আসে। ডিজিটাল ঘড়িতে সময় রাখতে ভেতরে ক্ষুদ্র কম্পিউটার রয়েছে। এতে ডায়ালে কাঁটার পরিবর্তে একটি ডিজিটাল ঘড়ি একটি সংখ্যা হিসাবে সময় দেখায়। কারো কারো মতে হাতঘড়ির উদ্ভব হয় ১৬০০ সালে স্প্রিং-এ দম দেয়া ঘড়ি থেকে, যার প্রচলন হয় ১৪০০ সালের দিকে। আবার অনেকেই বলেন, আর্কিমিডিস প্রথম হাতে ঘড়ি পরিধান করেন। এই কথার সত্যতা যাচাই সম্ভব হয়নি।
তৃতীয় পর্বঃ ঘড়ি কে আবিষ্কার করেন ৩য় পর্ব
সুত্রঃ বিজ্ঞানীদের জীবনি আবিষ্কারের কথা।