গবেষকরা ধারণা করেন, এই পৃথিবী যখন মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত হলো– তখন থেকেই তারা সময় হিসেব করে জীবনের গতি-প্রকৃতি পরিচালনা করার চেষ্টা শুরু করেছিল। তখনকার বুনো যাযাবর মানুষও সময় অনুযায়ী চলার চেষ্টা করতো। সূর্য উঠলে দিনের কাজকর্ম শুরু করা আর রাত হলে একটা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করা প্রত্যহিক কর্তব্যকর্মের মতোই হয়ে গিয়েছিল। এরপর দিন বদলের পালায় সূর্য ওঠা আলোয় ভরা দিনের মতো বোঝার চেষ্টা করতো সকালের আলো ফুটে উঠতে কত দেরি। এভাবেই দিনে দিনে ঘড়ি আবিষ্কারের প্রতি মানুষের চাহিদা জন্মাতে শুরু করে।
Photo: Wrist Watch
বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, যান্ত্রিক বা অন্যান্য উপায়ে সময় দ্বারা ট্রাকিং করার পদ্ধতি সর্বপ্রথম ৫৫০০ বছর আগে প্রাচীন মিশরের মেসোপটেমিয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলে আবির্ভূত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের সূর্যালোক, বালি ঘড়ি এবং জল ঘড়ি নির্মানের ফলে, এই যন্ত্রগুলির জ্ঞান শীঘ্রই ভূমধ্যসাগরে ছড়িয়ে পড়ে, যা গ্রিক, রোমান ও ফার্সি সাম্রাজ্যের মাধ্যমে সভ্যতা বিস্তৃতিলাভে সাহায্য করে। শত শত বছর পরে, মোমবাতি ঘড়ি, ধুপ ঘড়ি, তেল-প্রদীপ ঘড়ি, সহজ গিয়ার ঘড়ি, জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি থেকে শুরু করে আজকের স্মার্টওয়াচ সবই প্রাচীন ঘড়ি সভ্যতার ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ।
মাত্র ৭০০ বছর আগে লাতিন শব্দ ‘ক্লক্কা’ থেকে এসেছে ক্লক। কারো কারো মতে ইংরেজি শব্দ ‘daegmael‘ (যার অর্থ ‘দিন গননা’) এর পরিবর্তে ‘clock‘ শব্দটির প্রচলন হয়। আবার অন্য এক দলের মতানুযায়ী clock শব্দটি চৌদ্দ শতকে French শব্দ ‘cloche‘ (যার অর্থ ‘ঘন্টা’) শব্দ থেকে এসেছে।
যদিও ইতিহাসে এই মূল্যবান আবিষ্কারটির আবিষ্কারক হিসেবে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় না, তবে সময় নির্ণয় পদ্ধতি নিয়ে প্রাচীন মিশর, প্রচীন গ্রীস এবং প্রচীন রোম সভ্যতার অনেক পুরাতন নিদর্শন এবং দলিলপত্র পাওয়া গেছে।
Photo: Table Watch
ছয় হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয় সাম্রাজ্যে সমস্ত দিনকে ১২ ঘন্টায় ভাগ করা হয়েছিল। এছাড়া খ্রিষ্টপূর্ব ২৭০০ অব্দে চীনারাও একইভাবে সময়ের ভাগ করেছিল। গ্রীকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল দিন ও রাতকে ১২ ঘন্টায় ভাগ করার এই পদ্ধতি।
খ্রিষ্টীয় তেরো শতকে প্রথম সমান সময়ের ঘন্টার হিসাব চালু করা হয়। মিশরীও গণিতজ্ঞ আবু হাসান এই প্রথা চালু করেন। তিনিই প্রথম দিনকে সমান ১২ ঘন্টায় ভাগ করে নেন। ফলে দিন-রাত মিলে মোট ২৪ ঘন্টার প্রচলন হয়।
এরপর আস্তে আস্তে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে নানা ধরনের ঘড়ির আবির্ভাব হতে থাকে। সেই প্রাচীন কালের সূর্য ঘড়ি থেকে আজকের আধুনিক স্মার্ট-ওয়াচ।
বিশেষজ্ঞরা অনেক গবেষণা করে বের করেছেন প্রাচীনকালের ইতিহাস অনুযায়ী ঘড়ির পূর্বপুরুষ হিসেবে সূর্যঘড়িকে চিহ্নিত করা যায়। কারণ, তাঁদের মতে এটিই পৃথিবীর প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি। ধারণা করা হয় আনুমানিক কাঁটা নেই, নেই কোন টিকটিক শব্দ। তবে সময় দেয় একদম নিখুঁত। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর, এ নিয়েই সূর্যঘড়ি। তবে সূর্যঘড়ির ব্যবহার শুরু অনেক কাল আগে থেকেই। ধারণা করা হয় মিশরীয়রাই প্রথম প্রকৃতিনির্ভর অর্থাৎ সূর্য-ঘড়ি নির্মাণ করেছিল আর ইউরোপিয়ানরাই এই তত্বের উপর ভিত্তি করে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। কিন্তু ১৪ শতকের দিকে নির্মিত ঘড়িগুলোতে শুধুমাত্র ঘন্টা নির্দেশ করতে সক্ষম হত, মিনিট বা সেকেন্ড নির্ণয় করতে পারতো না। তাছাড়া বর্তমান ঘড়ির দুই ঘন্টা ছিল সেই ঘড়ির হিসেবে এক দিন, যার মানে একদিনে ঘড়িটি মাত্র দুবার ৩৬০ ডিগ্রী কোণে ঘুরতে পারতো। অর্থাৎ এই ঘড়ি দিয়ে সম্পূর্ন নির্ভুল ও সূক্ষ সময় গণনা করা যেত না। অবশেষে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ার হাইজেন্স ১৬৫৭ সালে এসে সম্পুর্ন নির্ভু লভাবে সেকেন্ড, মিনিট ও ঘন্টা নির্দেশকারী উন্নতমানের যান্ত্রিক ঘড়ির নকশা করেন।
সময় গণনার প্রচীন পদ্ধতি
সূর্যঘড়ি (sundial)
সূর্যঘড়ি নামক এক ধরনের সময় গণনা যন্ত্রের ব্যবহার শুরু অনেক কাল আগে থেকেই। ব্যবিলনে প্রথম প্রকৃতিনির্ভর ঘড়ি অর্থাৎ সূর্যঘড়ি নির্মিত হয়েছিল যা পরে প্রাচীন মিশরে আরো উন্নতি লাভ করে। সূর্যঘড়ি বা (sundial) গ্রীস এবং রোম সাম্রাজ্যে বিস্তার লাভ করে এবং প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়, তাছাড়া এর আকারও ছোট হয়ে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘড়ির ব্যবহার সর্বপ্রথম শুরু হয় সূর্যঘড়ি বা Sundial এর মাধ্যমে। কবে সর্বপ্রথম এই সূর্যঘড়ি আবিষ্কার হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে সবচেয়ে প্রাচীন যে সূর্যঘড়ি পাওয়া যায় তা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দে মিশরে নির্মিত হয়।
Photo: Sundial Clock
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা প্রায় ৩৫০০ B.C. তে গড়ে উঠেছিল। তখন সময় নির্ণয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল য়েরসূর্যের আলো। তারা দিনকে ১২ ভাগে ভাগ করে একটা কাঠির ছায়ার পৃর্ণন গতির উপর নির্ভর করে সময় নির্ণয় করত। এই পদ্ধতিকে সানডায়াল বা সূর্যঘড়ি পদ্ধতি নামে উল্লেখ করা হয়। সূর্যঘড়ির গঠন খুব সাধারণ। এতে একটি লম্বা কাঁটা বা নির্দেশক থাকে। এটি এমনভাবে একটি ডায়ালের সাথে লাগানো থাকে যাতে কাঁটাটির ছায়া ডায়ালটিতে পড়ে। ডায়ালটির গায়ে বিভিন্ন ঘন্টা ও মিনিট নির্ণয়ের জন্য চিহ্ন দেওয়া থাকে। দিনের বিভিন্ন সময়ে কাঁটাটির ছায়া ডায়ালের বিভিন্ন স্থানে পড়তো । এই ছায়া থেকে সময় নির্ণয় করা হতো।
সূর্যঘড়ি এমন একটি কৌশল যা সূর্যের অবস্থান নির্ণয়ের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে। সাধারণ নকশার সূর্যঘড়ি যেমন আনুভুমিক সূর্যঘড়িতে সময় নির্ণায়ক শৈলী হিসেবে প্রায়ই ধারালো প্রান্তবিশিষ্ট একটি চিকন রড থাকে। সূর্যের আলোয় সূর্যঘড়ির পৃষ্ঠতলের ঘন্টানির্দেশক রেখাগুলোতে সময়-নির্ণায়ক শৈলীর ছায়া পড়ে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সূর্য যখন আকাশ বরাবর পশ্চিম দিকে সরতে থাকে, সময়-নির্দেশক শৈলীর ছায়াপ্রান্তটিও তার সাথে সাথে বিভিন্ন ঘন্টারেখায় অবস্থান করতে থাকে। সঠিক সময় নিরূপণের জন্য, সূর্যঘড়িকে অবশ্যই পৃথিবীর আবর্তনের অক্ষের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অধিকংশ ডিজাইনেই, সময়-নির্ণায়ক শৈলীকে অবশ্যই স্বর্গীয় উত্তরমুখী ( স্বর্গীয় উত্তর মেরু বলতে নক্ষত্রের হিসাবে উত্তর বোঝায়, স্বর্গীয় উত্তর আর চৌম্বকীয় উত্তর এক নয়) হতে হয়। তাই, সময়-নির্ণায়ক শৈলীর আনুভুমিক কোণ সূর্যঘড়ির ভৌগোলিক অক্ষাংশের সমান হওয়া আবশ্যক। সানডায়াল পদ্ধতি তখন খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করছিল । কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় রাতের আঁধারে এবং মেঘলা দিনে সময় নির্ণয় করা নিয়ে। সে কারণে জ্যোতিষীরা রাতের আকাশে চাঁদ এবং নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বিকল্প আরেকটি পদ্ধতির সূচনা করেছিল। পদ্ধতিটি অনেকটা এই রকম ছিল–
Photo: Old Sundial Clock
একটা গোলাকার বোলের মাঝে কয়েকটি ছিদ্র করে একটি নির্দিষ্ট ছিদ্র একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্র বরাবর ধরা হত। অন্য ছিদ্রগুলো দিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি নক্ষত্রের অবস্থান থেকে সময় নির্ণয় করা যেত। এই পদ্ধতির কথা উল্লেখ রয়েছে ১৬ শতকে উদ্ধার করা প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে।
সাধারণ সস্তা কিন্তু দৃষ্টিনন্দন সূর্যঘড়িতে ঘন্টা-কোণগুলো পুরোপুরি সঠিক থাকে না, তাই এদের সাহায্য একেবারে নিখুঁত সময় নির্ণয় করা সম্ভবপর হয় না। তবু ১৪ শতাব্দীতে এসে ইউরোপিয়ানরা এই তত্বের উপর ভিত্তি করে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। এমনকি এখনো সূর্যঘড়ির ব্যবহার ফুঁড়িয়ে যায় নি।
পৃথিবীর বহু দেশে এই সূর্যঘড়ির প্রচলন ছিল। ছোট থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির হতো এই সূর্যঘড়ি। কিছু ছোট সূর্যঘড়ি ছিল যা মানুষ পকেটে কিংবা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতো। আবার কিছু বিশাল আকৃতির সূর্যঘড়ি বানানো হয়েছিল রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে। যাতে মানুষ সহজে সময় জানতে পারে। যেমন, প্যারিসের ‘লুক্সর অবেলিক্স’ নামের বিশাল আকৃতির সূচালো চারকোণা স্তম্ভটি একটি সূর্যঘড়ি।
পরবর্তীতে মুসলিম বিজ্ঞানী আবুল হাসান ১৩৭১ সালে ত্রিকোণমিতি এবং জ্যামিতির সূত্র প্রয়োগ করে সানডায়ালের আধুনিক ভার্সন সংস্ক্রণ করেন । যে অঞ্চলে পুরোনো সানডায়াল ঘড়িগুলো তৈরী হয়েছিল, মিশর আর ব্যবিলন- এগুলো কিন্তু একই অঞ্চলে । আর এই অঞ্চলের অবস্থানের কারণে সূর্যঘড়ির ছায়া দিনের সাথে ক্রমাগত পশ্চিম থেকে উত্তর হয়ে পূর্ব্দিকে সরে যেত। অর্থাৎ, দিন যত গরিয়ে রাতের দিকে যেত, ছায়াও ততো পশ্চিম দিক থেকে উত্তর দিক হয়ে পূর্ব দিকে যেত। সেখান থেকেই ঘড়ির কাঁটার দিকের ব্যপারটা এসেছে। আবুল হাসান সর্বপ্রথম সানডায়ালে একটি কাঁটা নির্দিষ্ট কোণে স্থাপন করেন যার সাহায্যে ঘন্টা মিনিট নির্ণয় করা যেত। এভাবে দিনের আলো ব্যবহার করে ঘড়ি দেখার কাজ চলত। কিন্তু এ ঘড়ির কিছু সমস্যা থাকার কারণে মানুষ নতুন ঘড়ি আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে। সূর্যঘড়ির অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল- এই ঘড়ি রাতের বেলায় ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া মেঘলা দিনেও এই ঘড়ি অচল হয়ে পড়তো। তাই আঠারো শতকের দিকে এ ঘড়ির ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্বঃ ঘড়ি ও তার আবিষ্কার ২য় পর্ব
সুত্রঃ বিজ্ঞানীদের জীবনি আবিষ্কারের কথা।