কথিত আছে, একদিন মুসা (আঃ) বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ওয়ায নসীহত করছিলেন। তখন শ্রোতাদের একজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মাঝে বর্তমানে সবচাইতে বড় আলেম কে ? হযরত মুসা (আঃ) উত্তর করলেন , বর্তমানে মানুষের মাঝে আমিই সবচাইতে বড় আলেম। তাঁর এ কথার সারমর্ম হচ্ছে- মানুষ যে এলেমের বদৌলতে সত্য পথের দিশা লাভ করে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত হয়, সে এলেমে তাঁর সমকক্ষ কেউ তৎকালীন মানুষের মাঝে নাই। কেউ কেউ বলেন, মুসা (আঃ) তীহ প্রান্তরে বনীইসরাঈলের উদ্দেশ্যে ওয়াযরত ছিলেন, তখন এক সাদা মেঘখন্ড তাঁর শিরোপরি ছায়া প্রদান করছিল। তখন তাঁর মনে জাগে, আজকের দিনে এলেম ও মাহাত্ম্য মর্যাদায় তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই।
হযরত মুসা (আঃ) এর কথা আজকের দিনে তাঁর সমকক্ষ কেঊ নাই – অর্থ ও উদ্দেশ্যের বিচারে বাস্তব সত্য। কেননা, তিনি আল্লাহর মনোনীত একজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রাসুল। আল্লাহর কিতাব তাওরাতের ধারক বাহক এবং হাফেয। যে তাওরাত সত্তর উটের বোঝা। তদুপরি তিনি অনেক বড় বড় মোজেযার অধিকারী। সরাসরি আল্লাহর সাথে কথোপকথনের মর্যাদায় মর্যাদাশীল। সমকালে হেদায়েতের এলেমের অধিকারী তাঁর সমকক্ষ কোন লোক ধরাপৃষ্ঠে ছিল না। এ সব দিক বিচারে তাঁর উক্তি বা মনে জাগ্রত চিন্তা যথার্থ। কিন্তু সে চিন্তা প্রকাশে তিনি যে শব্দের আশ্রয় নিয়েছেন তাহা মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে ভাল ঠেকে নাই। কারণ, তাঁর ব্যবহৃত শব্দ ছিল ব্যপক অর্থবোধক। যাতে বুঝা যাচ্ছিল, সমকালে সর্বপ্রকার এলেমেই তিনি বড় জ্ঞানী ছিলেন।
হযরত মুসা (আঃ)- এর উল্লেখিত ব্যপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহারের কারণে আল্লাহর তরফ থেকে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়। হে মুসা! আপনার চাইতে বেশী এলেমের অধিকারী আর কেউ আমার বান্দাকুলের মাঝে নাই, এমন ধারণা পোষণ সঙ্গত নয়। মাজমাউল বাহরাইন – দুই সাগরের সংযোগস্থলে এক ময়দান রয়েছে, সেখানে আমার এক বান্দা আছেন যিনি আপনার চাইতে অনেক বেশী এলেমের অধিকারী। বিশেষ কিছু এলেম তাঁর আপনার চাইতে বেশী রয়েছে। তথায় অবস্থান করে তিনি গোমরাহ পথভ্রষ্টদেরকে পথের দিশা দেন।
জীবিতকে মৃত এবং মৃতকে জীবিত করেন। এছাড়া আরো অনেক কাজ তাঁর দায়িত্বে সমর্পিত হয়েছে। আমার সে বান্দার নাম খিযির। হযরত খিযির (আঃ)- এর নাম শুনে হযরত মুসা (আঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উদ্বেগাকুল হয়ে পড়েন এবং সাক্ষাতের উপায় জানিয়ে দেবার জন্য আল্লাহর দরবারে আবেদন করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, আপনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাইলে একটি মাছ ভুনা করে থলেতে রেখে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান। যেখানে গিয়ে ভুনা করা মাছটি থলে থেকে বেরিয়ে সাগরের পথ ধরবে, সেখানেই আমার বান্দা খিযির অবস্থান করছেন।
হযরত খিযির (আঃ)- এর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে হযরত মুসা (আঃ) একটি মাছ ভুনা করে থলেতে পুরে ইউশা বিন নূন (আঃ)- কে সঙ্গে নিয়ে মাজমাউল বাহরাইন- দুই সাগরের সংযোগস্থলের দিকে রওয়ানা হন। হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গী হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) পথ চলতে চলতে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আর চলতে পারছেন না। তাই মুসা (আঃ) এক স্থানে পাথরের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সাথী ইউশা বিন নূন (আঃ) জাগ্রত রয়েছেন। যে স্থানে উপনীত হয়েমুসা ক্লান্ত অবস্থায় হযরত মুসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই মজমাউল বাহরাইন।
এখানে দুই সাগরের পানি যখন মিলিত হত তখন স্থির হয়ে মধ্যখানে একটি তাকের মত হয়ে যেত। এখানে আইনুল হায়াত- জীবনদায়ী ঝর্ণা নামে একটি ঝর্ণাধারা সাগরের সাথ মিশে গিয়েছিল। মুসা (আঃ) কে ঘুমন্ত রেখে ইউশা বিন নূন (আঃ) উক্ত ঝর্ণায়, কারো কারো মতে সাগরে অযু করতে যান। ভুনা মাছ যে থলেতে ছিল সেটিও তাঁর সাথে। তিনি থলেটি একটি পাথরের কাছে রেখে অযু সমাধা করেন। অযু করার পর থলের কাছে এলে এক ফোঁটা পানি টপকে ভুনা মাছের উপর পতিত হয়। মহান আল্লাহ পাকের হুকুমে মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রের ধরে । মাছটি যে পথ ধরে সাগরে প্রবেশ করে, সেখানকার পানি বরফের মত জমে যায়। মাছের চলার পথে সুড়ঙ্গ হয়ে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন কেউ একটি গভীর দাগ কেটে রেখেছে।
ইউশা মুসা (আঃ)- কে জাগ্রত করে ঘটনা অবহিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ পথ চলাজনিত অবসন্নতা নিয়ে সবেমাত্র ঘুমিয়েছেন। তাই জাগানোটা তাঁর কাছে ভাল লাগে নাই বিধায় আপাততঃ নীরবতা অবলম্বন করেন। ইতিমধ্যে ইউশা বিন নূন (আঃ) ও ঘুমিয়ে পড়েন। বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে দুই জ্নই উঠে আবার পথ চলতে শুরু করেন। কিন্তু মাছের ঘটনা মুসা (আঃ) কে অবহিত করতে ইউশা বিন নূন (আঃ) ভুলে যান। আলোচ্য স্থান থেকে চলতে শুরু করে উভয়ে একদিন একরাত অনবরত চলতে থাকেন। ভোরে হযরত মুসা (আ:) অত্যন্ত ক্ষুধা কবলিত হয়ে পড়েন। তিনি ইউশা বিন নূন (আঃ) এর নিকট ভুনা মাছটি চাইলেন যাতে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারেন। তখন ইউশা বিন নূন (আঃ)- এর মাছের ঘটনা স্মরণ হয় এবং মুসা (আঃ)- এর নিকট এ আজব ঘটনা বিবৃত করেন।
ইউশা বিন নূন (আঃ)- এর মুখে মাছের বিস্ময়করভাবে সাগর পথে গমনের কথা শুনে হযরত মুসা (আঃ) বুঝে ফেললেন, তাঁরা যে স্থানের উদ্দেশ্যে সফর করছেন তা পেছনে রয়ে গেছে। এমনকি উদ্দিষ্ট স্থান অতিক্রম করে বহুদুর সামনে অগ্রসর হয়ে গেছেন। তাঁর এও স্মরণ হল যে, ভুনা করা মাছটি তো খাওয়ার জন্য আনা হয়েছিল না। এটি উদ্দিষ্ট স্থানের পরিচিতি লাভের উদ্দেশ্যেই আনা হয়েছে। অথচ ক্ষুধার তাড়নায় তিনি সব কথা ভুলেই বসেছেন। কেননা, সফরের শুরুতেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে, যেখানে মাছটি হস্তচ্যুত হবে, সেখানেই তাঁর আরাধ্য জন হযরত খিযির (আঃ) রয়েছেন। তখন হযরত মুসা (আঃ) ইউশা বিন নূন (আঃ)- কে বললেন, আমরা যেস্থানের উদ্দেশ্যে সফর করছি সেখানেই মাছটি সাগরের পথ ধরেছে। সুতরাং আমাদের আবার পেছনে ফিরে যেতে হবে। তাই উভয়ে পুনরায় পেছনে প্রত্যাবর্তন করে যেখানে ঘুমিয়ে পরেছিলেন সেখানে আসেন। এসে দেখেন, মহা মুল্য পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে এক মহাপুরুষ বসে আছেন। মুসা (আঃ) তাঁকে সালাম করেন । ইনিই হযরত খিযির (আঃ)।