স্থির CAMERA তো তৈরি হলো। এই CAMERA দিয়ে লাগাতার ছবি তোলার কাজও চলতে শুরু করলো। প্রয়োজনীয়
মূহূর্তের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য স্থির ছবির গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু মানুষের মনের সাধ পূরণ করার জন্য চাই চলমান দৃশ্যাবলী ধারিণ ও সংরক্ষণ। এর ফলে বিজ্ঞানীরা নতুন উদ্যমে জোরেসোরে গবেষণা করতে শুরু করলেন।
MOVIE CAMERA, চলচ্চিত্র ক্যামেরা বা সিনে- ক্যামেরা হচ্ছে ফটো ক্যামেরার একটি টাইপ যা একটি ছবি লেন্সর- এর ওপরে বা একটি ফিল্ম-এর ওপরে ফটো-এর একটি দ্রুত ক্রম নেয়।
একটি স্থির ক্যামেরা, যা একটা সময়ে একটা ছবি তুলতে পারে, অন্যদিকে সিনেমা ক্যামেরা ছবির একটি সারি নেয়; প্রত্যেক ছবি একটি ‘ফ্রেম’ গঠন করে। এটা একটি থেমে থেমে কৌশলের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। ফ্রেমগুলো পরে একটি সুনির্দিষ্ট গতিতে সিনেমা প্রজেক্টরে চালানো হয়, যাকে ফ্রেম রেট বলা হয় (প্রতি সেকেন্ডে ফ্রেম সংখ্যা)। যখন ছবিগুলো একটি নির্দিষ্ট ফ্রেম রেটে দেখানো হয় তখন একজনের চোখ ও মস্তিস্ক আলাদা আলাদা ছবিগুলো একসাথে জোড়া দিয়ে একটা গতির ভ্রম দেখতে পায়। ২০১০ সাল থেকে চলচ্চিত্র ভিত্তিক মুভি ক্যামেরাগুলো ডিজিটা ল মুভি ক্যামেরা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে শুরু করে।
মানুষ যখন ক্যামেরার সাহায্যে চিত্রকে স্থায়ী করতে সমর্থ হলো, তখনই অনেকের মনে চিন্তা আসে, আমরা যেমন ঘুরে বেড়াই, হাত-পা নাড়ি, কথাবার্তা বলি, ঠিক সেই ভাবে ছবিকেও সচল ও সবাক করতে পারি না। যদি হতো, তাহলে কী মজাটাই না হতো।
এই পরিকল্পনাটা মনে হয় প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়া স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিস্টহাতা লেল্যান্ড সাহেবের মাথায় এসেছিল। ঘোড়ায় চড়তে বেজায় ভালবাসতেন তিনি। একদিন মাইব্রিজ নামে সুদক্ষ এক ফটোফ্রাফারকে জানালেন তার মনের কথা এবং বললেন, যেমন করে হোক ঘোড়া ছোটানো অবস্থায় একটা সচল ছবি তাঁকে তুলে দিতেই হবে। মাইব্রিজ কয়েকদিন ধরে ব্যাপারটিকে নিয়ে বেশ ভালভাবে চিন্তা করলেন। শেষে উদ্ভাবন করলেন এক অভিনব উপায়।
মাইব্রিজ করলেন কী! চব্বিশটি ক্যামেরা এনে একটা খোলা মাঠের একপ্রান্তে সমদূরত্বে বসিয়ে রাখলেন। সবগুলো ক্যামেরার শাটারের সঙ্গে বাঁধলেন একগাছা করে সরু সূতো। সূতোর অপর প্রান্তগুলোকে সোজাসুজি মাঠের ও প্রান্তে টেনে নিয়ে গিয়ে টান টান করে বাঁধলেন খুটির সঙ্গে। তারপর লেল্যান্ড সাহেবকে নির্দেশ দিলেন ক্যামেরার সম্মুখ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতে।
ছুটে চললো লেল্যান্ডের ঘোড়া। আর ঘোড়ার ক্ষুরের ধাক্কায় সূতাগুলো একে একে পটপট করে ছিড়ে গেল এবং শাটারগুলো খুলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধও হয়ে গেল। আর সেই সাথে উঠে গেল ঘোড়ার চলন্ত ছবি। তবে ঐ পদ্ধতিতে মাইব্রিজ চব্বিশটি ক্যামেরার সাহায্যে গতিশীল অশ্বের পিঠে লেল্যান্ড সাহেবের বিভিন্ন অবস্থান অনুযায়ী ছবি ধরে রাখতে পেরেছিলেন মাত্র, কিন্তু প্রদর্শন করতে পারেননি। ছবিকে গতিশীল করার উপায় আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে টমাস আলভা এডিসনের।
এই উদ্দেশ্যে তিনি দুটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যন্ত্র দুটির একটির নাম কিনেটোগ্রাফ এবং অপরটির নাম কিনেটোস্কোপ। প্রথম যন্ত্রটি ব্যবহার করেছিলেন চলচ্চিত্র গ্রহণের জন্যেবং ইস্টম্যান নামে জনৈক মার্কিন বিজ্ঞানী সেলুলয়েডের তৈরি ফিল্ম আবিষ্কার করেছিলেন। এডিসন সেই ফিল্মকেই কাজে লাগিয়েছিলেন এবং
তৈরি করেছিলেন দৃশ্যবস্তুর বিভিন্ন অবস্থানের ছবি। তারপর ওকে একটা বাক্সের মত যন্ত্রের ভেতরে রোলারে জড়িয়ে রেখেছিলেন। রোলারকে ঘোরানোর জন্য একটা হাতলও যুক্ত করেছিলেন। হাতল ঘোরালে রোলার থেকে ছবি খুলে যেত এবং আর একটি রোলারে আপনা হতে জড়িয়ে যেতো।
বাক্সটির সামনে এডিসন রেখেছিলেন দুটি বড় বড় ছিদ্র। মাত্র দুজন দর্শক উপযুক্ত দর্শনী দিয়ে সেই সচল ছবিকে দেখতে পারতেন। এডিসনের এই যন্ত বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। সেই কারণে চলচ্চিত্রের উন্নতির জন্য অনেকেই মাথা ঘামাতে শুরু করেন এবং এডিসনের যন্ত্রটিকে লুফে নেন।
আলোকচিত্রগ্রাহী ফিল্ম (Photographic film) হলো স্বচ্ছ পাস্টিক ফিল্ম বেসের একটি স্ট্রিপ বা শীট যার এক পাশে থাকে জিলেটিন ইমালশন যাতে থাকে ছোট ছোট আণুবীক্ষণিক আলোক-সংবেদী সিভার হ্যালাইড স্ফটিক। স্ফটিকের আকার ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ফিল্মের সেনসিটিভিটি, কনট্রাস্ট এবং রেজুলেশন নির্ধারিত হয়।
১৬৪৫ সালে জার্মান বিজ্ঞানী অ্যাথানাসিউস কিরখের আবিষ্কার করলেন ম্যাজিক লন্ঠন। স্বচ্ছ মাধ্যমের উপর ছবি এঁকে সেটাকে লেন্সের মধ্যে দিয়ে পর্দায় প্রতিফলিত করাই ছিল ম্যাজিক লন্ঠনের আসল কায়দা। এভাবে ক্যামেরা বা ফিল্ম তৈরির আগে তৈরি হল প্রজেক্টরের আদি সংস্করণ। ১৮১৬ সালে ফরাসী রসায়নবিদ নিসেফোরে নিপসে প্রথম ফটোগ্রাফ তোলেন। ১৮২৪-এ জোসেফ পেটো বেলজিয়ামে আবিষ্কার করেন ক্যামেরা শাটার। এর পরপরই ১৮৩০ সালে বৃটিশ বিজ্ঞানী ফক্স ট্যাবলেট তৈরি করেন প্রথম ফটো নেগেটিভ। এভাবে ক্যামেরা আর ফিল্ম তৈরির পথে মানুষ এক কদম অগ্রসর হয়। ১৮৭২ সালে একটি মজার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম মুভি ক্যামেরা তৈতি হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্ণর লেল্যান্ড ছিলেন ঘোড়ার রেসের দারুন ভক্ত। ১৮৭২ এ তিনি তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে আজব বাজী ধরলেন। লেল্যান্ড বললেন ঘোড়া দৌড়ানোর সময় কোন এক মুহূর্তে তার সবগুলো পা-ই শূন্যে থাকে। বন্ধু বললেন এটা হতেই পারে না। বাজীতে জেতার জন্য লেল্যান্ড ইংরেজ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মাইব্রীজকে ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের ছবি তুলতে বললেন। সাত বছরের একটানা গবেষণার পর মাইব্রীজ রেসের মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা বসিয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের ছবি তুললেন। সত্যিই দেখা গেল, ছুটন্ত ঘোড়ার সবগুলো পা-ই বিশেষ একটি মুহূর্তে শূন্যে থাকে। এই গবেষণা কাজে লাগিয়ে ১৮৮২ সালে মাইব্রীজ ড্রাই পেট ফটোগ্রাফিক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। এবছর এই পদ্ধতি ব্যবহার করে জুল আরে নামে একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন ফটোগান। তৈরি হলো প্রথম মুভি ক্যামেরা। সবদিক থেকেই এটি ছিল রাইফেল, শুধু কার্তুজের বদলে এতে থাকত ফটো-প্লেট। এই রাইফেল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে তুলতেই চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রহণের স্থায়ী নাম হয়ে গেল-শুটিং।
১৮৯০ সালে ইস্টম্যান তৈরি প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফটোফিল্ম। ১৮৯৫ সালে ২৮ ডিসেম্বর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক জ্বলজ্বলে দিন। ফরাসী দুই ভাই – অগুস্ত লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪)
আর লুই লুমিয়ের ১৮৬৪-১৯৪৮) এদিন প্যারিসে আর্কল্যাম্প প্রজেক্টর দিয়ে নিজেদের তৈরি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন।
চলচ্চিত্রের উন্নতির মূলে যাঁর অবদান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাঁর নাম টমাস আরমাট। ইনিই প্রথম বাক্সের পরিবর্তে পর্দার অপর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ফলে বহুজনে একসঙ্গে বসে ছবি দেখার সুযোগ লাভ করে।
টমাস আরমাটের চলচ্চিত্র মূকাভিনয় ছাড়া আর কিছু ছিলনা। সাধারণত যাত্রা-থিয়েটার থকে CAMERA দিয়ে ছবি তোলা হতো। দর্শনকালে নাটকের কুশীলবরা হাত পা নাড়াতেন, অঙ্গভঙ্গি করতেন, ঠোট নাড়াতেন কিন্তু শোনা যেত না। তবে আগাগোড়া পুরো কাহিনীকে নিতে পারতেন না। অংশ বিশেষ ধরে রাখতেন এবং প্রদর্শন করতেন। উপরোক্ত ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল।
কিন্তু একই জিনিস সবসময় যেহেতু মানুষের মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হয় না এবং সবসময় নতুনের পিয়াসী সে, তাই এই মুকাভিনয় এবং কাহিনী-শূন্য চিত্রে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারলো না। পারলেন না নতুনের প্রতি যাদের সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ- সেইসব বিজ্ঞানী ও শিল্পীরা।তাঁরা ভাবলেন, ভাল ভাল কাহিনীকে কী চিত্ররূপে দেওয়া যায় না?
সুত্রঃ বিজ্ঞানীদের জীবনি আবিষ্কারের কথা।