এয়ারক্রাফট (AIRCRAFT)
মানুষের ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা শুধু স্থল ও জলপথেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা উধর্বগামী হয়ে আকাশপথেও (এয়ারক্রাফট) ধাবিত হয়েছে। সেকালে গ্রীক পুরানের মধ্যে দিয়েই মানুষের আকাশে ওড়ার চেষ্টা দেখা যায়, ইকেরাস, ডীডেলাস, পারসিউস এই চেষ্টারই প্রমাণ।
যাই হোক, পাখির মত আকাশে ওড়ার বাসনা মানুষকে আকাশযান (এয়ারক্রাফট) তৈরিতে উৎসাহিত করল। প্রথমে মানুষ নিজের দেহে নকল পাখা লাগিয়ে ওড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তারপরে কোন কিছুতে চড়ে আকাশে বেড়ানোতেই যেন মন দিল। হাওয়ার জন্য হালকা আকাশযান (এয়ারক্রাফট) তৈরি করল মানুষ প্রাথমিক ভাবে।
Related: কেন মোবাইলের ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
হাওয়া গরম হলে তা হালকা হয় এবং ওপরে ওঠে- এই এই ধারণা থেকে তৈরি হল ফানুস। একটা কাগজের গোলক তৈরি করে তার খোলা মুখের তলায় আগুন জ্বালিয়ে গরম হাওয়ার সাহায্যে গোলকটি আকাশে ওড়ান হত- এটিই ফানুস। বর্তমানে বেলুনের পূর্বপুরুষ এই ফানুস।
১৭৮৩ সালে এই ধরণের একটি কাপড়ের তৈরি বেলুন আকাশে ওড়ান জ্যাক্স এতিয়েস মঁগলফিয়ে এবং যোসেফ মিশেল মঁগলফিয়ে। এদের বেলুনের নিচে একটি ছোট খাঁচা জুড়ে তাতে একটি ছাগল, একটি মোরগ ও একটি ভেড়া রাখা হয়। বেলুনের খাঁচায় চড়ে সর্বপ্রথম পিলাৎরে দ্য রোজিয়ের এবং মারকুইস দ্য অরলান্দেস মানুষ হিসেবে আকাশে ঘুরে এলেন ১৭৮৩ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর।
Related: প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সেকাল একাল
হাইড্রোজেন গ্যাস হাওয়ার চেয়ে হালকা প্রমাণিত হওয়ার পর বেলুনে গরম হওয়ার বদলে হাইড্রোজেন গ্যাসের ব্যবহার শুরু হল। বেলুনের আকৃতিতে এল পরিবর্তনে এবং একে প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন দিকে চালনাও করা হত। পটলাকৃতি, চোঙাকৃতি বেলুন তৈরি হল। এইভাবে আকাশে নানা বেলুন চলতে লাগল। এগুলিকে বলা হত এয়ার-শিপ।
বেলুনকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করা হত। ১৮১৭ সালে বেলুনে করে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা হল। এরপর বেলুন আরও মজবুত, দ্রুতগামী, অধিকক্ষণ আকাশে টিকে থাকতে এবং অধিক উঁচুতে উঠতে সক্ষম হল ক্রমশঃ। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বেলুনে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৮৫১ সালে। হেনরি জিফার্ড এই বেলুনটি চালান। ক্রমশ বেলুনের সঙ্গে যুক্ত হয় বিদ্যুত-চালিত ও গ্যাসোলিন যন্ত্র। বেলুনের গতিবেগ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জার্মানীর কাউন্ট ফার্ডনান্ড ফন জেপেলিন তৈরি করেন একটি বৃহদাকৃতি বেলুন। ভেতরে যাত্রী বসবার ও যন্ত্রপাতি বওয়ার আলাদা প্রকোষ্ঠ ছিল। জেপেলিনের নাম অনুযায়ী এটির নাম দেওয়া হয় জেপেলিন। এই ধরণের জেপেলিন প্রথম মহাযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।
৭৭৬ ফুট লম্বা জার্মানীর গ্রোফ জেপেলিন ১৯২৯ সালে ২১ দিনে পৃথিবীর চারপাশে আকাশপথে এক চক্কর দিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এরপর আকাশযানের ক্ষেত্রে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
ইতিমধ্যে বায়ুর চেয়ে ভারী আকাশযান তৈরিতে উৎসাহিত হয়ে পড়ে মানুষ। জার্মানী অটো মিলিয়েনথাল ১৮৯৯ সালে বায়ুর চেয়ে ভারী একটি আকাশযান তৈরি করেন। এতে দুটো পাখা লাগানো ছিল, মাঝে খাঁচার মত যন্ত্রে বসে চালক পা দিয়ে যন্ত্রটি চালাত। এ রকম একটি যান চালাতে গিয়ে মিলিয়েনথাল শেষ অবধি মারা যান। এরপর পাখনাযুক্ত এই ধরনের আকাশযান তৈরি হতে থাকে, এগুলিকে Glider বলা হয়।
Related: Telephone (টেলিফোন )-মার্গারেট হেলো নামে Alexander Graham Bell এর girlfriend ছিল না
আমেরিকার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় (অর্ভিল রাইট, উইলবার রাইট) আরও উন্নত Glider তোইরিতে মাতলেন। তাঁরা আকাশে ওড়ার পথে প্রথমদিকে খুব কমই সফল হলেন।
তবে শেষ পর্যন্ত ১৯০৩ সালে ১৭ই ডিসেম্বর তাঁদের তৈরি আকাশযান পর পর চারবার আকাশে ওঠে। শেষবার উইলবার একনাগাড়ে ৮২৩ ফুট উড়ে যান। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এরপর আরো উন্নত আকাশযান তৈরি করতে সক্ষম হন। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আকাশযানের নাম দেওয়া হয় এরোপ্লেন। ফ্রান্সের লুঁই ব্রেরিয়ট তাঁর এরোপ্লেনে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এরোপ্লেন ব্যবহার করে সুফল Power plane তৈরিতে উতসাহ বেড়ে যায়। যুদ্ধোত্তর কালে এরোপ্লেন আরো উন্নত হতে থাকে। পাখাওয়ালা এরোপ্লেন তৈরি হতে থাকে। ১৯১৯ সালে স্যার আর্থার ব্রাউন ও স্যার জন অ্যালকক আটলান্টিক মহাসাগর হলেন তাদের এরোপ্লেনে চড়ে। নানা রকম বিমান তৈরির কোম্পানী চালু হল। এরপর ১৯২৬ সালে রিচার্ড ইভলিন বার্ড তাঁর এরোপ্লেনে করে উত্তর-মেরু ঘুরে আসেন এবং পরে তিনি দক্ষিণ-মেরু ঘুরে আসতেও সফল হয়েছিলেন।
Related: ইনটিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি-এর ব্যবহার ও মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কার
১৯৩১ সালে এরোপ্লেন চেপে পৃথিবী প্রদক্ষিণও সম্ভব হয়- সম্ভব করেন দুই আমেরিকান- ওয়াইলি গোস্ট এবং হ্যারল্ড গ্যাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরে এরোপ্লেন তৈরির ক্ষেত্রে নানা উন্নত সংযোজন ঘটতে থাকে। বম্বার, ফাইটার, জেট ইত্যাদি বিমান এই সময়েরই আবিষ্কার। এরোপ্লেনগুলি মালবহনেও সক্ষম হয়ে ওঠে এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আজ অবধি নানা ধরণের উন্নত বিমান তৈরি হয়েছে।
বিমান দ্রুতগামী, আরো বেশি দ্রুতগামী হতে থাকে। আজ একখানা জেট বিমানের গতিবেগ ঘন্টায় ১,৭০০ মাইল, এই গতিবেগ শব্দের গতিবেগের থেকেও বেশি। আধুনিক এইসব (এয়ারক্রাফট) বিমান তৈরিতে আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চীন দারুন কৃতিত্ব দেখিয়েছে।
সুত্রঃ বিজ্ঞানীদের জীবনি আবিষ্কারের কথা।